অর্ণব আইচ: বাচ্চুর তিনটি নাটকের পরিচালক আমিই ছিলাম। হোক না পাড়ার নাটক। তবু খুব মন দিয়ে অভিনয় করত, ভাল নাটক লিখতও। খুব ভালো ক্রিকেটও খেলত।
দোতলার ঘরে বসে স্মৃতিচারণ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর ‘গৌরদা’র। অর্থাৎ, উত্তর কলকাতার তেলিপাড়ার রামধন মিত্র লেনের বাসিন্দা গৌর ভদ্র। স্বনামধন্য বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর ভাইপো গৌরবাবুর বয়স ৮৩ বছর। তাঁর থেকে বছর তিনেকের ছোট ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। যদিও বুদ্ধদেবকে বরাবর তাঁর ডাকনাম ‘বাচ্চু’ বলেই ডেকে এসেছেন গৌরবাবু। তাঁর ঘরের জানালা দিয়েই দেখা যায় তিনতলা বাড়িটা। ছোটবেলা থেকেই ১১ নম্বর বাড়ির ডি ব্লকের তিনতলায় ভাড়া থাকতেন বুদ্ধবাবুরা। তিনতলার দু’টি ঘরের লাগোয়া এক চিলতে ছাদ। সেই ছাদ থেকে ঘুড়ি ওড়াতেন বালক ‘বাচ্চু’। খেলতেন ভাইদের সঙ্গে। কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে এসে পৌঁছন এই হলুদ রঙের বাড়িতেই। নিচের দুটি তলায় থাকতেন তাঁদেরই আত্মীয় ও পরিজনরা। তবে ভট্টাচার্য পরিবার ছেড়ে দেওয়ার পর ওই ব্লকটির সংস্কার করা হয়েছে। সেখানে এখন আর থাকেন না কেউ।
নিজের দোতলার ঘরে বসে গৌর ভদ্র বলেন, “তখন পাড়ায় বাচ্চুদের একটা গ্রুপ ছিল। বাচ্চু মিশত বিদ্যুৎ নাগ, রাম ভট্টাচার্য, উদয়ন ভট্টাচার্যদের সঙ্গে। বিকেল হলেই মাঠে ক্রিকেট খেলতে বেরিয়ে যেত। আমায় ডাকত ‘গৌরদা’ বলে। তখন পাড়ায় পুজো ঘিরে আমাদের সবার উন্মাদনা ছিল। আর পুজো মানেই ছিল পাড়ার ছেলেমেয়েদের নানা অনুষ্ঠান। আর বাচ্চুর বন্ধুরা সব মেতে উঠত নাটকের উৎসবে। আর সেই নাটকের পরিচালক ছিলাম আমি। মনে আছে, ‘মাস্টারমশাই’ নামে একটি নাটকে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিল বুদ্ধদেব, মানে বাচ্চু। আর যখন স্কুল ছেড়ে বের হচ্ছে, তখন বাচ্চু ক্লিফোর্ড ওডেটসের ‘ওয়েটিং ফর লেফটি’ নাটকের ভাবানুবাদ ‘বিদায়ের অপেক্ষা’ লেখে। মুক্তাঙ্গনে সেই নাটক অভিনীত হয়। এখনও মনে পড়ে, আমার পরিচালনায় বাচ্চু আর ওর বন্ধুরা খুব ভাল অভিনয় করে প্রশংসা কুড়ায়। তখনও বাচ্চু সরাসরি রাজনীতি করত না। প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বাম ছাত্র সংগঠনে যোগ দেয়। পরবর্তীকালে যখন উত্তর কলকাতার এই ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিয়ে ভট্টাচার্য পরিবার ট্যাংরা ও এন্টালিতে চলে যায়, তখনও পুরনো পাড়াকে বাচ্চু ভোলেনি। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। আমাদের সঙ্গে ব্যবহার ছিল অত্যন্ত অমায়িক। এমনকী, পরবর্তীকালে যখন বাচ্চু মুখ্যমন্ত্রী হয়েছে, তখনও যোগাযোগ রেখেছে আমাদের সঙ্গে। যখন উত্তর কলকাতায় রাজনৈতিক সমাবেশ বা মিটিংয়ে আসত, আমায় ডেকে পাঠাত। পাড়ার খবরাখবর নিত। একসঙ্গে চা খেতাম। একটা ঘটনা মনে পড়ছে। পাশের পাড়ার মুকুন্দ দাসকে ছোটবেলায় চিনত বাচ্চু। নন্দনে একটি অনুষ্ঠানের টিকিট পাওয়া যাচ্ছিল না। নন্দনের পিছনের গেটের কাছে, যেখান দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী প্রবেশ করতেন, দাঁড়িয়ে ছিল মুকুন্দ। কখন যে আমাদের বাচ্চু মুকুন্দকে দেখেছে, সে নিজেও বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারল, যখন এক পুলিশ অফিসার তাকে বললেন, ‘সিএম ডাকছেন।’ উপরে গিয়ে তার সমস্যা শুনে সামনে বলে পুরো অনুষ্ঠান দেখার ব্যবস্থা করে দেয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, মানে বাচ্চু।”