• একজন ‘ভিশনারি’, যিনি বৃষ্টি আনতে চেয়েছিলেন
    এই সময় | ০৯ আগস্ট ২০২৪
  • সুবোধ সরকার

    মাননীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন আপাদমস্তক এক নির্লোভ মানুষ। তখনও তিনি মুখ্যমন্ত্রী হননি, কিন্তু সকলেই তাঁকে ভবিষ্যৎ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখতেন। কথা বলতেন ঝকঝকে বাংলায়, সে বাংলায় বাংলা অনার্সের বকুলতলা ছিল না, ছিল প্রতিটি শব্দের স্পষ্ট উচ্চারণ, প্রতিটি যতিচিহ্নের স্মার্ট উদ্‌যাপন। তাঁর উচ্চারণে কোনও ধুলো ছিল না, যেমন তাঁর ব্যক্তিত্বের কোনও ভাঁজে কোথাও ধুলো ছিল না।তিনি ছিলেন একজন ‘ভিশনারি’, একজন ‘রেইনমেকার’, বৃষ্টি আনতে চেয়েছিলেন, একজন স্বপ্ন দেখাতে চাওয়া ‘মেঘমানুষ’। শব্দটা স্তালিন থেকে নিলাম। লেখক বরিস পাস্তারনাক-এর নামটা স্তালিন লাল কালি দিয়ে গোল করে অ্যারো দিয়ে লিখেছিলেন, ‘ক্লাউড ডুয়েলার’। বুদ্ধদেববাবু একজন ট্র্যাজিক হিরো, তাঁর স্বপ্ন দেখানোটাই হলো তাঁর অ্যাকিলিসের গোড়ালি।

    আজ থেকে ২৬ বছর আগে, নন্দন চত্বরে কবিতা উৎসব চলছে। শিশির মঞ্চে উইংসের ধারে শঙ্খ ঘোষ আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বসে মন দিয়ে কবিতা শুনছেন তিনি। আমরা মঞ্চে কবিতা পড়ছি। আমি আমার সদ্য প্রকাশিত বই ‘ভালো জায়গাটা কোথায়?’ থেকে তিনটি কবিতা পড়েছিলাম। তিনি উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।

    ‘ঘুস’ কবিতাটা নিয়ে অনেকক্ষণ বললেন। আমার শিহরণ হচ্ছিল, তিনি তখনও সস্নেহে আমাকে ধরে আছেন। প্রথম তাঁর শারীরিক স্পর্শ পেয়ে আমি আনন্দে ঘামতে শুরু করেছিলাম। তিনি আমাকে শিশির মঞ্চের পেছনে, যেখানে এখন শিশির ভাদুড়ী দাঁড়িয়ে আছেন, সেখানে দাঁড় করিয়ে মার্কেজ়ের কথা বলতে শুরু করলেন, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছি, তিনি সাদা পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে দিলেন এবং আমাকে অবাক করে এগিয়ে দিলেন প্যাকেট। ওই তীব্র মুহূর্তে আমি মিথ্যে বলতে পারিনি যে, আমি খাই না।

    এক বার নন্দন তিনে মার্কেজ়ের চিত্রনাট্য করা একটা ফিল্ম দেখাবেন বললেন। মৃণালদা, সুনীলদা, দিব্যেন্দু পালিত আর আমি বসে আছি। বসে আছি তো বসেই আছি। অংশুদা (অংশু শূর) পায়চারি করছেন। তিনি এলেন প্রায় এক ঘণ্টা লেট করে। এসেই বললেন এতক্ষণ ডাকাত সামলাচ্ছিলাম, তিন কুখ্যাত ডাকাত ধরা পড়েছে। শুরু হলো ফিল্ম।

    আমি সুনীলদাকে ফিসফিস করে বললাম, ‘বাংলার ডাকাত থেকে আর এক ডাকাত, মার্কেজ় তো ল্যাটিন আমেরিকার ডাকাত।’ সে দিন ফিল্ম শেষ হওয়ার পরে মার্কেজ়কে নিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা বলে গেলেন। হতবাক হয়ে শুনেছিলাম তাঁর অভিজ্ঞতা। এ রকম মার্কেজ় ভক্ত আমি আর এ-জীবনে দেখিনি। কলকাতায় তিনি মার্কেজ়কে আনতে চেয়েছিলেন। তিনি অনুবাদ করেছিলেন ‘ক্ল্যানডেনস্টিন ইন চিলে’।

    ‘গোপনে চিলিতে’— অসাধারণ এক অনুবাদ। পাশাপাশি কাফকার ‘মেটামরফসিস’ বাংলায় নাট্যরূপ দিয়েছিলেন। অশোক মুখোপাধ্যায় পরিচালনা করেছিলেন। আমার সঙ্গে কোনও দিন রাজনীতি নিয়ে কোনও কথা বলেননি। কিউবা থেকে চোখ দেখিয়ে ফিরে এসে হেমিংওয়ে নিয়ে অনেক গল্প বলেছিলেন বইমেলার দোতলায় বসে।

    তখন বইমেলা পার্ক স্ট্রিটে হতো। কিউবা চোখের জন্য বিখ্যাত। তবু আমি বললাম, কিউবায় গেলেন কেন? ক্রিকেটভক্ত বললেন, ‘মারাদোনা কিউবাতে চোখ দেখান, চোখের জন্য কিউবা-ই ভালো।’
  • Link to this news (এই সময়)