রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর প্রয়াণের খবরটা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ভাইপো গৌড় ভদ্রের কানে আসতে বেশি সময় লাগেনি৷ এককালের পাড়াতুতো ভাইয়ের প্রয়াণে শোকাহত তিনিও৷ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্মৃতিবিজড়িত ওই বাড়িতে একাই থাকেন অশীতিপর বৃদ্ধ।
১৯৪৪ সালের পয়লা মার্চ শ্যামপুকুরের ১১/ডি রামধন মিত্র লেনের তিনতলা বাড়িতেই জন্মগ্রহণ করেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ৷ সেখানেই বেড়ে ওঠা৷ শৈশব ও কৈশোর, বুদ্ধদেবের প্রতিটা মুহূর্তের সাক্ষী থেকেছে এই পাড়া৷ সাক্ষী থেকেছেন গৌড়বাবুও৷ তখন অবশ্য পাড়ার ‘বাচ্চু’র গায়ে রাজনীতিবিদের সিলমোহর পড়েনি৷ বুদ্ধবাবুর কথা উঠতেই অশ্রুমিশ্রিত কণ্ঠে গৌড়বাবু বললেন, ‘‘ছোটো থেকেই ওঁর মধ্যে একটা প্রতিভা ছিল৷ পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলোতেও ছিল খুবই ভালো৷ পাড়াতে ওঁকে সবাই খুব ভালবাসতো৷’’ একই সঙ্গে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সংস্কৃতিমনস্কতারও সাক্ষী থেকেছেন বছর তিরাশির গৌরবাবু৷ তাঁর কথায়, ‘‘ছোট থেকেই পাড়ার পুজোতে বিভিন্ন নাটক করত ‘বাচ্চু’৷ নিজে নাটকও লিখত একটা সময়। আবৃতিও করতো খুব ভালো৷’’
১৯৬৬ সাল নাগাদ কলেজে পড়ার সময় সপরিবারে পাড়া ছাড়েন বুদ্ধবাবু৷ তারপর পেরিয়ে গিয়েছে অনেকটা সময়৷ রাজ্যের বিধায়ক থেকে শুরু করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সিংহাসনে বসেছেন পাড়ার ‘বাচ্চু’৷ কিন্তু শ্বেতশুভ্র ধুতির মতোই ছিল তাঁর জীবনযাপন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও কোনোদিন গায়ে লাগতে দেননি হেভিওয়েট তকমা। পুরনো সতীর্থদের খোঁজ নিতে ভোলেননি কোনওদিনই৷ গৌড় ভদ্রের কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরও আমার খোঁজ নিয়েছে৷ খোঁজ রাখত পাড়ারও৷ পাড়ায় কোনও সমস্যা আছে কি না, তাও নিয়ম করে খোঁজ নিত ‘বাচ্চু’৷ নন্দন চত্বরে কোনও অনুষ্ঠানে দেখা হলেও চিলুবিলু ভিড় এড়িয়ে চলত কথোপকথন”৷ গৌড়বাবুর কথায়, ‘‘একবার নন্দনে আমাদের পাড়ার পরিচিত এক ভদ্রলোক গিয়েছিলেন। কিন্তু টিকিট পাইনি অনুষ্ঠান দেখার৷ সেটা হয়তো ‘বাচ্চু’ লক্ষ্য করেছিল৷ সেই লোক নন্দন বিমুখ হতেই ডাক পড়েছিল আবার৷ এক নিরাপত্তরক্ষী ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন ওঁর কাছে৷ তাঁকে টিকিট জোগাড় করে দিয়েছিল অনুষ্ঠান দেখার’’৷
জীবনকালেই মরণোত্তর দেহদান করে গিয়েছেন রাজ্যের শেষ বাম সেনাপতি এবং দ্বিতীয় বাম মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য৷ সেই মতো শুক্রবার বিকেলে তাঁর দেহ নিয়ে যাওয়া হয় এনআরএস হাসপাতালে৷ সেই খবর অবশ্য আগেই পেয়েছিলেন গৌড়বাবু৷ বছর তিরাশির বৃদ্ধ এখন সোজা হয়ে হাঁটতে অসমর্থ৷ হাঁটার সঙ্গী বলতে ওয়াকার৷
অন্যদিকে, পাড়ার ‘বাচ্চু’দাকে বেশ সমীহ করেই চলতেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর আর এক পড়শি বছর একষট্টির শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়৷ পাশাপাশি বাড়ি হলেও তাঁকে বেশ ভয়ই পেতেন শঙ্করবাবু৷ বুদ্ধবাবুর সঙ্গে তাঁর শেষবারের মতো দেখা হয়েছিল বছর খানেক আগে৷ ১৯৮৭ সালে শঙ্করবাবুর বিয়ের সময় নিজে আসতে না পারলেও, বাড়ির অন্য সদস্যদের হাত দিয়ে পাঠিয়েছিলেন উপহার৷ তবে আক্ষেপ, কোনও দিনও ভয় কাটিয়ে সেইভাবে কথা বলে হয়ে ওঠা হয়নি ‘বাচ্চু’দার সঙ্গে৷
পাড়ার অদূরেই অবস্থিত শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয়৷ সেখানেই ১৯৫৪ থেকে ১৯৬১ সাল, দীর্ঘ আট বছর পড়ুয়া হিসেবে কাটিয়েছেন তিনি৷ কৃতি ছাত্রের প্রয়াণে মন খারাপ স্কুলেরও৷ স্কুলের বর্তমান সহকারি প্রধান শিক্ষক হরিনাথ নন্দীর কথায়, ‘মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন স্কুলে বহুবার এসেছেন৷ তবে নিজস্ব রক্ষীদের কোনও দিনও স্কুলের মধ্যে নিয়ে আসতেন না৷ বাইরে রেখে তবেই প্রবেশ করতেন ভিতরে৷’