সময়টা ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি হবে। আমরা তখন কলেজে পড়ি। শিয়ালদহের কাছে এক জায়গায় একটা নাটক করতে গিয়েছি। হঠাৎ বাইরে গোলমাল। দেখলাম কংগ্রেসের এক ট্রেড ইউনিয়ন নেতা লোকজন নিয়ে এসেছেন নাটক আটকাতে। এমন সময়ে শান্ত গলায় ‘আমি দেখছি’ বলে বেরিয়ে গিয়েছিল বুদ্ধ।আমাদের নাটক শেষ হওয়ার পরেও ওর পাত্তা নেই। বাইরে বেরিয়ে দেখি যাঁরা গোলমাল করতে এসেছিলেন, তাঁদের সকলকে নিয়ে একটা চায়ের দোকানে বসে হইহই করে আড্ডা মারছে। এমনটাই ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ওর সঙ্গে আমার আলাপ সেই স্কুলে পড়ার সময় থেকে।
এক স্কুলে নয়— ও পড়ত শৈলেন্দ্র সরকার স্কুলে, আমি ছিলাম হরনাথ হাইস্কুলের ছাত্র। স্কুলের একদম নিচু ক্লাস থেকেই অসাধারণ গুছিয়ে কথা বলত। সে সময়ে স্কুলে-স্কুলে বিতর্ক প্রতিযোগিতা হতো। ও নিজের স্কুলের প্রতিনিধিত্ব করত, আমি আমার স্কুলের।
সেই সূত্রেই আলাপ, পরিচয় এবং বন্ধুত্ব। পরে দু’জনেই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হলাম। মনে পড়ে একবার সঞ্জীবনী কেবিনে বসে একসঙ্গে আড্ডা হচ্ছে, এমন সময়ে খবর এল পুলিশ এসেছে। তখন আমাদের ব্যাপক ধরপাকড় করা হতো। এখনও মনে পড়ে পুলিশের খবর পেয়ে আমরা বিভিন্ন দরজা দিয়ে একে একে কেটে পড়েছিলাম।
ক্রমশ আমি গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে পড়ি। বুদ্ধও তখন প্রতিষ্ঠিত নেতা। আমাকে নাটকে ব্যবহার করার প্রস্তাব করেছিল ও। কিন্তু তার পরেই দেখি আমাকে কলকাতা পুরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলার পদে দাঁড় করানোর কথা ঘোষণা করা হয়েছে। খুব অভিমান হলো বুদ্ধর উপর। কিন্তু কোথায় কী!
আমাকে ডেকে পাঠিয়ে একটু গল্প করল। আমার সব রাগ গলে জল হয়ে গেল। ওই যে! স্রেফ কথা বলে সমস্যা সমাধানের অসাধারণ সেই মনমোহিনী ক্ষমতা। বুঝলাম, স্কুলজীবন পেরিয়েও সেটা অটুট রেখেছে ও। সেই বন্ধুকে আর কখনও দেখব না। আর কখনও ওর সঙ্গে কথা হবে না।