• শিল্পায়ন ছিল তাঁর ভিত্তি, পার্টির পতনই হয়ে গেল ভবিষ্যৎ...
    এই সময় | ১১ আগস্ট ২০২৪
  • শুভাশিস মৈত্র

    মুখ্যমন্ত্রী পদে বসার বেশ কয়েক বছর আগের কথা। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর ‘দুঃসময়’ নাটকের মুখবন্ধে জীবনানন্দের সুরঞ্জনা কবিতার একটি লাইন ব্যবহার করে লিখেছিলেন, ধ্বংস, রক্ত ও মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে নাটকে আনার চেষ্টা করেছি ‘মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়’।আর মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হয়ে ছ’-সাত বছরের মাথায় নন্দীগ্রামে জমি দখলকে কেন্দ্র করে সিপিএমের সূর্যোদয়, তাঁর ‘পেড ব্যাক ইন দেয়ার ওন কয়েন’ উক্তি, পুলিশের গুলিতে জমি আন্দোলনকারীদের ১৪ জনের মৃত্যু, এই সব কিছুর ফলে গভীর হৃদয়ের অনুসন্ধানকারী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিরোধীদের চোখে হয়ে উঠেছিলেন হার্মাদ বাহিনীর নেতা। সংবাদ-মাধ্যমে ‘হার্মাদ’ শব্দের প্রবেশ তাঁর সময়েই। তাঁর পুলিশ তখন বিরোধীদের চোখে ‘দলদাস’। যদিও বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে এটা ছিল তাঁর পরিচয়ের একটি অংশ। বুদ্ধদেবের একটা অন্য পরিচয়ও ছিল।

    সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাইপো, পশ্চিমবঙ্গের সপ্তম মুখ্যমন্ত্রী, প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তনী বুদ্ধদেব ছাত্র রাজনীতির মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছিলেন সিপিএমের শীর্ষস্তরে। ১৯৭৭-এ প্রথম বার কাশীপুরের বিধায়ক। ১৯৮২-র ভোটে হেরে গিয়েছিলেন। তার পর থেকে ২০১১ পর্যন্ত তিনি বিধানসভা নির্বাচনে লড়েছেন যাদবপুর কেন্দ্র থেকে। ২০১১-তে বুদ্ধবাবু নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন একদা তাঁর স্বরাষ্ট্রসচিব মণীশ গুপ্তের কাছে।

    বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই প্রথম দলীয় রাজনীতিতে, বাম রাজনীতির সংস্কৃতিতে একটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছিলেন। কর্মসংস্কৃতি বদলানোর চেষ্টা করেছিলেন। নিজের দলে তিনি অপ্রিয় হয়েছিলেন— ‘বন্‌ধ’-এর রাজনীতির জন্য তিনি ‘লজ্জিত’, এই মন্তব্য করে। তিনি সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘ডু ইট নাও’। শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের অপছন্দ হয়েছিল তাঁর সেই উক্তি।

    তাঁর আহ্বান ছিল শিল্পোন্নত বাংলা গড়ার। উইপ্রো-র চেয়ারম্যান আজিম প্রেমজি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘দেশের সেরা মুখ্যমন্ত্রী।’ শিল্পায়নে বুদ্ধদেবের তৎপরতা দেখে ইনফোসিস-এর ফিনান্স ডিরেক্টর মোহনদাস পাই বলেছিলেন, উনিশ শতকের মতো ফের কলকাতা থেকে বাংলার নবজাগরণ শুরু হবে। ১৯৯৩-এ শিল্পনীতি ঘোষণার মধ্যে দিয়ে শুরুটা জ্যোতি বসুর আমলে হলেও বুদ্ধদেবের সময়ে বহু গুণ গতি পেয়েছিল শিল্পায়নের তৎপরতা।

    তার প্রমাণ সল্টলেকের আইটি সেক্টর। শিল্পের প্রয়োজনে শহরে গতি আনতে বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার নির্মাণের শুরুও তাঁর সময়েই। ২০০৬-এর বিধানসভা ভোটের পরে শপথের দিনই শিল্পপতি রতন টাটার সঙ্গে বৈঠক নিয়ে বুদ্ধদেবের মন্তব্য ছিল, সেটা তাঁর জীবনের সেরা দিন। সিপিএমে অনেকেই খুশি হননি কমিউনিস্ট নেতার ক্যাপিটালিস্ট শিল্পপতির সঙ্গে বৈঠককে এই ভাবে জীবনের সেরা দিন বলায়।

    বুদ্ধদেব বিভিন্ন সভায় তখন বলতেন, চাষ থেকে রোজগার কমছে। সময়ের সঙ্গে চাষির পরিবার বড় হচ্ছে। জমির উপর চাপ বাড়ছে। চাষির সন্তান চিরকাল চাষ করবে না, সে-ও কলকারখানায় চাকরি চায়। তার জন্যেও শিল্পায়ন দরকার। রাজ্যের বেকারত্ব দূর করতেও চাই শিল্পায়ন।

    কিছু স্বীকৃতিহীন মাদ্রাসা থেকে নানা কৌশলে সন্ত্রাসবাদীরা তাদের সদস্য সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগেই এই ধরনের মন্তব্য করে তিনি অনেকের চক্ষুশূল হয়েছিলেন। অনেক পরে, ২০২১ সালে রাজ্য গোয়েন্দা বিভাগের প্রাক্তন প্রধান দিলীপ মিত্র, তাঁর বই ‘অপারেশন ব্ল্যাক স্টিলেটো: মাই ইয়ার্স ইন ইন্টেলিজেন্স’-এ লিখেছেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছিল, তবে গোয়েন্দা তৎপরতার ফলে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল।

    তারও অনেক পরে, ২০০৮-এর নভেম্বরে মেদিনীপুর থেকে একটি প্রকল্প উদ্বোধনের পর, তৎকালীন ইস্পাত মন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ানের সঙ্গে ফেরার পথেও মাওবাদীদের মাইন বিস্ফোরণের হাত থেকে তিনি এবং রামবিলাস অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন। তিনি অবশ্য এসব কখনওই রাজনীতির ইস্যু করেননি।

    বিশ্বাস করতেন বামপন্থা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। নিয়মিত পড়াশুনো করতেন। ‘মার্কসবাদ সত্য কারণ ইহা বিজ্ঞান’, সিপিএম-এ এমন বিশ্বাসী মানুষ অসংখ্য থাকলেও, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সমাজতন্ত্রের সাফল্য নিয়েই সন্দেহ ছিল। এই সংশয় বাড়ে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর। ২০০৫ সালে দলের শারদীয় পত্রিকায় লিখেছিলেন, ১৯৩০-এ লেনিনের রাশিয়ায় গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘রাশিয়ার চিঠি’তে সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু কমিউনিস্টদের চোখে কোনও ত্রুটি ধরা পড়ল না কেন?

    ছাত্রজীবনে নাকি সার্ত্রের ভক্ত ছিলেন। তবে রাজনীতির বুদ্ধদেবের যেমন পছন্দের ছিল মায়াকভস্কি, মার্কেজ, তেমনই মন দিয়ে পড়তেন সমাজতন্ত্রের সমালোচক মিলন কুন্দেরার লেখা।

    রাজনীতির মানুষরা সাধারণত হন একমাত্রিক এবং দ্বিধা-দ্বন্দ্বহীন। বুদ্ধদেব ছিলেন বহুমাত্রিক, সংশয়-পূর্ণ। কিন্তু এ কথা ঠিক, তিনি দলের গণ্ডি ছাড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত দেখার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাঙালি তাঁকে বিশ্বাস করেনি।
  • Link to this news (এই সময়)