যাদবপুর থেকে আর জি কর হাসপাতাল! লিঙ্গভেদে নৃশংসতা, 'সাইকোপ্যাথে'র বলি পড়ুয়ারা?
প্রতিদিন | ১২ আগস্ট ২০২৪
রমেন দাস: ‘মেয়েটাকে আমার শেষ করে দিল!’ আর জি করে নৃশংস খুনের পর চিকিৎসক-পড়ুয়ার মায়ের আর্তনাদ শুনেছে দেশ। প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন চিকিৎসকরা। ফের তোলপাড় হয়েছে রাজ্য-রাজনীতি। নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে সরব প্রায় সকলেই!
কিন্তু কেন? অপরাধী মানে অপরাধী, তার অন্য কোনও পরিচিতি নেই, নিশ্চিত এই বাক্যের অন্দরেও ঘুরে ফিরে আসছে একের পর এক ঘটনার কথা। ২০২৩ সাল। আগস্ট মাস। এমনই এক সময়ে কলকাতায় (Kolkata) পড়তে এসে মরতে হয়েছিল এক ছাত্রকে। সেই ঘটনার অভিঘাত উত্তাল করেছিল দেশ। প্রশ্ন উঠেছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিয়ে। আর জি কর না যাদবপুর, দুটো ঘটনার মধ্যে আকাশ-জমিন পার্থক্য। আবার কোনটা বেশি নৃশংস, আত্মহত্যা না খুন, সব তদন্ত সাপেক্ষ হলেও অনেকেই বলছেন এই দুই ঘটনা কোথাও গিয়ে যেন এক! শূন্যতা, হাহাকার, সন্তান হারানোর বেদনা, পড়তে পড়তে অকালে মৃত্যুর কাছে ওঁরা দু’জনেই যেন এক! ছেলে, মেয়ে নির্বিশেষে নির্যাতনের টানাপোড়েনে ওঁরা অভিন্ন!
যাদবপুরের (Jadavpur Student Death) মৃত ছাত্রের বাবা বলছেন, ”আর জি করের ছাত্রীও আমার সন্তানসমা। ঘুমোতে পারছি না! হয়তো দুটো ঘটনা অনেক আলাদা। কিন্তু সেই সন্তান হারানো, ছেলেটাকে অত্যাচার, মেরে ফেলা। আমি আজও বিশ্বাস করি, আমার ছেলেটা নিজে থেকে মরেনি! আমার ছেলেকেও উলঙ্গ করা হয়েছিল। আরও কষ্ট বাড়ছে, এই সব মৃত্যুর বিচার কবে হবে জানি না।”
এখানেই অপরাধ, অপরাধীর বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির মধ্যেই প্রশ্ন উঠছে অন্যত্র। প্রত্যেক মুহূর্তেই কি মানসিক বিকৃতির কবলে পড়ছে একের পর সফট টার্গেট? মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অনির্বাণ রায় বলছেন, ”ব়্যাগিং অবশ্যই একটা ব্যাধি। মানসিক বিকৃতি বলতেই পারেন। এটি সামাজিক ব্যাধি। কিন্তু সাইকোপ্যাথ বা আরও বৃহত্তর প্রেক্ষিতে যদি বলেন সেটার সঙ্গে ব়্যাগিংয়ের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। তবে আমি বলব, যেকোনও অপরাধের বিচার হোক। অপরাধীর পরিচয় শুধুমাত্র অপরাধী হওয়া প্রয়োজন, এর সঙ্গে মানসিক কিছু জুড়ে দেওয়া, অপরাধীর অপরাধকে লঘু করে দিতে পারে।”
এই প্রসঙ্গেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বৈদ্যনাথ ঘোষ দস্তিদার। তাঁর কথায়, “ওই ছাত্রীর জায়গায় যদি কোনও পুরুষ থাকতেন, তাঁকেও যে এভাবে ধর্ষণ করে খুন করা হত না, আমি নিশ্চিত নই। আসলে এই ধরনের অপরাধ যারা ঘটায়, এরা মানসিক রোগগ্রস্ত। চিকিৎসা পরিভাষায় এরা অ্যান্টি সোশ্যাল পার্সোনাল ডিসঅর্ডারে ভোগে। অপরাধ প্রবণতা রয়েছে আগে থেকেই। খানিকটা সাইকোপ্যাথ বলা যেতেই পারে। আপনি যদি বিশ্বের সিরিয়াল কিলার নিয়ে একটু চর্চা করেন, দেখবেন এরা প্রত্যেকেই প্রায় এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন। যাদের কাছে নৃশংসতা আনন্দের। তাদের আত্মসন্তুষ্টি দেয়, অপরাধ করে।” ওই চিকিৎসকের কথায়, “এই ধরনের ঘটনায় যুক্তদের যদি ইতিহাস দেখেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ছোটবেলায় যৌন নির্যাতনের শিকার। পারিবারিক বিবাদ। নানা ধরনের অশান্তি ছিল জীবনে। তারপর নেশায় বুঁদ হয়ে যাওয়া।”
কিন্তু বিকৃত মানসিকতার হলেও আর জি কর হাসপাতালের ঘটনার নৃশংসতায় (Doctor’s Death) একজন জড়িত, অর্থাৎ একজনের পক্ষেই এই কাজ করা সম্ভব? এই বিষয়ে কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন ডেপুটি কমিশনার সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “সম্ভব, আমার মনেহয় এই ঘটনায় একজন জড়িত থাকার সম্ভাবনা প্রবল। এদের সাইকোপ্যাথ বা মানসিকভাবে বিকৃত বললে ভুল হবে না। অপরাধ প্রবণতা থেকেই এরা অপরাধ করে। আমার বিশ্বাস, পুলিশ খুব ভালো কাজ করছে। যোগ্য তদন্তকারীরা দেখছেন বিযয়টি। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পর, মনেহয় না এই ঘটনায় কাউকে আড়াল করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা হতে পারে। ঘৃণ্য এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হবে, পুলিশ কমিশনার নিজে বলেছেন।”
আবার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বৈদ্যনাথ ঘোষ দস্তিদার বলছেন, “এক্ষেত্রে আর কারও সাহায্য বা যোগ থাকতে পারে। কিন্তু এটাও বলছি, সাইকোপ্যাথ বা অ্যান্টি সোশ্যাল পার্সোনাল ডিসঅর্ডারে যারা ভোগে, এদের পক্ষে নৃশংস অপরাধ করা একার দ্বারাও সম্ভব। আমার মনেহয় অভিযুক্ত অনেক দিন ধরেই ধারাবাহিক অপরাধে যুক্ত। তাকে অন্য কেউ সাহায্য করতেই পারেন! তবে ওই মেয়েটি ওখানে না থাকলে অন্য কোনও মহিলা বা পুরুষ থাকলেও এই ক্রিমিনাল মানসিকতার লোকটি একা বা একাধিক মিলে একই অপরাধ যে করতেন না, এমন বলা যায় না। যদিও সবটাই তদন্তসাপেক্ষ বিষয়।”
এখানেই প্রশ্ন উঠেছে বহিরাগত হাসপাতালে ঢুকে গিয়ে এমন ভয়ানক কাণ্ড ঘটাবে কীভাবে? কেউ দেখতে পেলেন না? প্রাক্তন পুলিশ কর্তা সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ”অবশ্যই আর জি কর হাসপাতাল (RG Kar Hospital) কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ছিল। নিরাপত্তার বন্দোবস্ত ঠিকঠাক হলে এই ঘটনা আটকে দেওয়া যেত।”
মনোচিকিৎসক তথা আর জি কর মেডিক্যালের (RG Kar Medical College) প্রাক্তন ছাত্র বৈদ্যনাথের কথায়, “আমি আর জি করে পড়েছি। রাতে কাজ করেছি। কখনও ভয় লেগেছে। কিন্তু এই ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে, নিশ্চিত এমন কেউ আছেন, বা এই ঘটনায় যিনি অভিযুক্ত তিনি সব জানতেন। হাসপাতালের সঙ্গে অবশ্যই নিবিড় যোগ রয়েছে। সেটা চিকিৎসক বা চিকিৎসা পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত কেউ নন, একথা আমি বলছি না। তবে আমার বিশ্বাস, এই ধরনের অপরাধ বা বিকার কোনও চিকিৎসকের মধ্যে থাকতে পারে না! কর্তৃপক্ষ কেন উদাসীন ছিল, এই বিষয়েও ভাবনা প্রয়োজন। নইলে এমন ঘটনা বারবার ঘটবে!”