এই সময়: মেরেকেটে ২৪ মিনিট! এই সময়ের মধ্যে একজন পূর্ণবয়স্ক, সুস্থ-সবল মানুষকে শ্বাসরোধ করে খুন-ধর্ষণের পর হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাওয়া কি সম্ভব? আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিহত তরুণী চিকিৎসকের যৌনাঙ্গ-সহ শরীর জুড়ে যে ভাবে ১১টি জায়গায় ক্ষতচিহ্ন মিলেছে, গলার কণ্ঠা ও থাইরয়েড বোন ভাঙা হয়েছে, তাতে একজনের পক্ষে এই পাশবিক অত্যাচার চালানো সম্ভব কি না- আপাতত সেটাই জানতে চাইছেন তরুণীর পরিবার ও আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা।পাশাপাশি এই ঘটনার সঙ্গে আরও কেউ জড়িত কি না, তা নিয়ে নিশ্চিত হতে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও নিচ্ছে পুলিশ। কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল রবিবার বলেছেন, 'আপাতত একজনই জড়িত বলে জানা গিয়েছে। তবে আরও কেউ আছে কি না, আমরা সেটা দেখছি। তবে কোনও কিছু লুকোনো হচ্ছে না।' যদিও তরুণীর বাবা ও মা দু'জনেই দাবি করেছেন, তাঁদের মেয়ে মাঝেমধ্যেই বলতেন, তাঁর উপর চাপ রয়েছে। হাসপাতালেও যেতে চাইতেন না।
এমনকী ধৃত সঞ্জয় রায়কে 'সুপারি' দিয়েও খুন করানো হয়েছে কি না, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন তাঁরা। গোটা বিষয়টা তাঁরা জানিয়েছেন কলকাতা পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দলকেও (সিট)। আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের দাবি, এই নারকীয় ঘটনায় শুধু পুলিশি তদন্ত হলেই চলবে না, বিচার বিভাগীয় তদন্তও করতে হবে। সিটের তদন্তের অগ্রগতিও প্রতিদিন সামনে আনতে হবে।
'সুপারি' দিয়ে খুন করা হয়নি তো?
তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত সঞ্জয়কে টানা জেরা করছেন তদন্তকারীরা। যদিও এ দিন সোদপুরে মেয়ের শ্রাদ্ধের কাজ সেরে সাংবাদিকদের কাছে তরুণীর মা প্রশ্ন তোলেন, 'মেয়েকে সুপারি দিয়ে খুন করানো হয়নি তো?' তাঁর সংযোজন, 'হাসপাতালের চেস্ট মেডিসিন বিভাগকেও আমরা সন্দেহের মধ্যে রেখেছি। আমাদের মনে হচ্ছে, ভিতরের লোকও জড়িত থাকতে পারে। যে গ্রেপ্তার হয়েছে তাকে যে 'সুপারি' দেওয়া হয়নি, সেই গ্যারান্টি কে দেবে?'
তরুণীর মা এ-ও জানান, মেয়ে তাঁকে মাঝেমধ্যেই বলতেন, রোগীর চিকিৎসা তিনি যে ভাবে করতে চাইতেন, সে ভাবে পারতেন না। তাহলে কারা তাঁকে কাজে বাধা দিতেন, সেই বিষয়টাও পুলিশ খতিয়ে দেখছে। তরুণীর বাবার কথায়, 'পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে কী বলেছেন, তা বাইরে বলতে পারব না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর আমাদের ভরসা আছে। গোপনাঙ্গে অত্যাচার করে খুন করার কথা ফরেন্সিক রিপোর্টে বলা হয়েছে বলে শুনেছি। সেখানে কতজন ছিল, সেটা পুলিশ দেখছে বলে আমাদের জানিয়েছে।'
কর্মক্ষেত্রে আরও কিছু সমস্যা হতো বলেও তরুণী তাঁর বাবা-মাকে জানিয়েছিলেন। মায়ের কথায়, 'সিনিয়ররা সহযোগিতা করত না। বাধা দিত। সিনিয়র ডাক্তাররা মেয়েকে দিয়ে বেশি কাজ করানোর চেষ্টা করতেন। নাইটে ডিউটি থাকলেও স্লিপ রুম ছিল না। চারটে ছেলের সঙ্গে একা ডিউটি করতে হতো। আমরা সঠিক তদন্ত এবং দোষীর চরম শাস্তি চাইছি।'
মেয়ে খুন হওয়ার পরেও যে ভাবে হাসপাতালের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার পরিচয় দিয়ে একজন ফোন করে মেয়ে অত্মহত্যা করেছে বলে তাঁদের জানানো হয়, তাতেও ক্ষুব্ধ তরুণীর পরিবার। আজ, সোমবার থেকে মেয়ের খুনে দোষীদের গ্রেপ্তারির দাবিতে ধর্নায় বসতে পারেন তরুণীর পরিবার।
নেপথ্যে কি আরও কেউ!
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার ভোররাত ৪টে ৩ মিনিটে ইমার্জেন্সি বিল্ডিংয়ের চার তলার করিডরের সিসিটিভি ক্যামেরার ধরা পড়েছিল সঞ্জয়ের গতিবিধি। তখন সেমিনার হলের দিকে যাচ্ছিল সে। এর পর ভোর ৪টে ২৭ মিনিট নাগাদ আবার তার বেরিয়ে যাওয়ার ছবিও ধরা পডে়ছে। মাত্র ২৪ মিনিটের ব্যবধান। আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের অনেকেরই বক্তব্য, ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারের একার পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়।
কারণ, ইনকোয়েস্টের সময়ে শরীরের যে যে জায়গায় ক্ষতচিহ্ন মিলেছে, তাতে একজন এ ভাবে নির্যাতন চালাতে পারে বলে মনে হয় না। পুলিশ জানিয়েছে, অন্য কারও উপস্থিতি অকুস্থলে ছিল কি না, তা নিয়ে নিশ্চিত হতে উদ্ধার হওয়া রক্ত, চুলের নমুনা এবং চশমা, চুলের ক্লিপ, ল্যাপটপ, ম্যাট্রেস-সহ বিভিন্ন জিনিসের ফরেন্সিক পরীক্ষাও করা হচ্ছে। ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা রক্তের নমুনার সঙ্গে নিহত তরুণী এবং অভিযুক্তের ডিএনএ স্যাম্পেল মিলিয়ে দেখা হবে। অন্য কারও রক্ত বা চুল ঘটনাস্থলে ছিল কি না, তা নিয়ে তদন্তকারীরা নিশ্চিত হতে চাইছেন। রবিবার দুপুরে কলকাতা পুলিশের সায়েন্টিফিক উইংয়ের অফিসাররা অকুস্থলের প্রতিটি জায়গার মাপজোক করেছেন।
প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা?
ধৃত সঞ্জয়কে হেফাজতে নেওয়ার পর পুলিশ জানতে পেরেছে, এই ঘটনা ঘটিয়ে বেরিয়ে যায় সঞ্জয়। তার পরে কোনও জায়গায় প্রচুর মদ্যপান করে। আবারও ঢোকে হাসপাতাল চত্বরে। তদন্তকারীরা জানার চেষ্টা করছেন, খুন-ধর্ষণের পরে কোথায় মদ্যপান করেছিল সঞ্জয়? কারণ, তখন কোনও পানশালা বা মদের দোকান খোলা থাকার কথা নয়। তাহলে অন্য কারও সঙ্গে মদ খেয়েছিল কি সে? আবারও সে হাসপাতাল চত্বরে ঢুকেছিল কেন? বিষয়টা জানাজানি হয়েছে কি না, সেটা বুঝতেই?
তদন্তকারীদের দাবি, হাসপাতাল চত্বর থেকে সঞ্জয় চলে যায় সল্টলেকে ফোর্থ ব্যাটেলিয়নের ব্যারাকে। সেখানে নিজের জামা, জিন্সের ভিতরে হাফ প্যান্ট এবং জুতোয় লাগা রক্তের দাগ ধুয়ে ফেলে। যাতে প্রমাণ লোপাট করা যায়, সেজন্য পরিকল্পনামাফিক সঞ্জয় সেগুলো ধুয়ে ফেলে বলে দাবি পুলিশের। যদিও সেই জামা-প্যান্ট-জুতো পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে ফরেন্সিকে পাঠানো হচ্ছে। দেখা হচ্ছে তার মোবাইলের কল ডিটেলস ও টাওয়ার লোকেশনও।
আততায়ী একজন নয়, দাবি বিশেষজ্ঞের
নিহত তরুণীর পরিবার এবং আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের একাংশ যে সন্দেহ করছেন, তার সঙ্গে একমত প্রবীণ ফরেন্সিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অজয় গুপ্ত। ঘটনাপরম্পরা ও সামনে আসা বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে তাঁর পর্যবেক্ষণ- 'ফরেন্সিক মেডিসিনের পাঠ্যবইতেই লেখা আছে, যদি নির্যাতিতার শরীরে একাধিক মারাত্মক আঘাত থাকে কিংবা দু'-তিনটির বেশি সাধারণ আঘাতও থাকে, তা হলে একজনের বেশি অপরাধী থাকার আশঙ্কা কখনও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর এ ক্ষেত্রে তো ১০-১২টি মারাত্মক আঘাত রয়েছে নির্যাতিতার শরীরে।'
তাঁর কথায়, 'ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে যেহেতু বলা রয়েছে, গলা টিপে এবং নাক-মুখ চেপে ধরে শ্বাসরোধ করা হয়েছিল নির্যাতিতার, তাই দু'টি কাজ একজনের পক্ষে করা কখনওই সম্ভব নয়। নিশ্চিত ভাবেই এই কাণ্ডের নেপথ্যে সঞ্জয় রায় ছাড়াও এক বা একাধিক অপরাধী রয়েছে।'
শেষ দেখে ছাড়ব!
কলকাতার সিপি বিনীত গোয়েল জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত এক অভিযুক্তই এর পিছনে রয়েছে বলে মনে হলেও তাঁরা সব দিক খতিয়ে দেখছেন। রবিবার তিনি বলেন, 'তরুণীর পরিবারকে অটোপসি রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। ওঁদের সঙ্গে কথাও বলা হয়েছে। তবে অকুস্থলে তিনজনের সিমেনের নমুনা পাওয়া গিয়েছে বলে যে সব গল্প ঘুরছে, সেগুলো একদমই গুজব। এর বাইরে কেউ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।' এই ঘটনা সম্পর্কে ডাক্তারি পড়ুয়াদের কাছে কোনও তথ্য থাকলে তা-ও জানানোর আবেদন করেছেন সিপি।
তাঁর কথায়, 'কোনও খবর আপনাদের কাছে থাকলে বা কেউ জড়িত আছে মনে করে থাকলে পুলিশকে জানান। আপনাদের জানানো তথ্য গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে। কোনও প্রশ্ন থাকলেও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।' এনিয়ে তথ্য জানাতে প্রয়োজনে টোল-ফ্রি নম্বরও চালু করতে পারে লালবাজার।
এ দিন নিহত তরুণীর বাড়িতে যান কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (১) মুরলীধর শর্মা। তারপরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'ওই মেয়েটি আমারই মেয়ে, আমার বোন, আমার ভাইঝির মতো। আমরা এর শেষ দেখে ছাড়ব।' আন্দোলনকারীদের দাবি মতো আরজি কর হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশের এসি-কেও এ দিন সরানো হয়েছে।