• আন্দোলনে বহু চিকিৎসক, দুই রোগীমৃত্যু বঙ্গে
    এই সময় | ১৩ আগস্ট ২০২৪
  • এই সময়: কয়েনের উল্টোপিঠ তো থাকবেই। আরজি কর হাসপাতালে ছাত্রীমৃত্যুর জেরে যে আন্দোলন আছড়ে পড়েছে রাজপথে, তারও উল্টোপিঠে জমা হচ্ছে দুর্ভোগের ছবি। সেখানে ফুটে উঠছে চিকিৎসা না-পেয়ে চোখের সামনে নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর অসহায়তা।তালিকায় আপাতত দুই। অভিযোগ, বুকে ব্যথা নিয়ে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সিতে সোমবার চার ঘণ্টা বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকার পরে মৃত্যু হয় পিয়ারুন শেখ (৩৫)-এর। আর সোমবার সকালেই টোটোর ধাক্কায় গুরুতর জখম শিবম শর্মা (৯)-কে বালুরঘাট হাসপাতালে আনা হলে সেও বিনা চিকিৎসায় মারা যায় বলে অভিযোগ উঠেছে। শিবমের মৃত্যুর পরে তার আত্মীয়রা হাসপাতালে ভাঙচুর চালান বলেও অভিযোগ।

    রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ডাক্তারদের আন্দোলন। সেই আন্দোলনের পীঠস্থান আরজি কর হাসপাতালে সোমবার বিকেলের দৃশ্য — শুনশান ইমার্জেন্সি। কোল্যাপসিবল গেট আধখানা টানা। মেল-ফিমেল ওয়ার্ডের দরজায় চেয়ার নিয়ে বসে থাকা স্বাস্থ্যকর্মীরা বলেছেন, ‘পরিষেবা বন্ধ। ডাক্তারবাবুরা কেউ নেই। নিজেরাই দেখে নিন।’ খোলা দরজার মধ্যে দিয়ে ইমারজেন্সি ওয়ার্ডের যতটুকু দেখা গিয়েছে তাতে সত্যিই একজনেরও দেখা মেলেনি। অগত্যা হতাশ হয়ে ফিরেছেন রোগীর পরিজনরা।

    বহু জায়গা থেকেই চিকিৎসক এবং নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা এসে সোমবার আরজি করের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছিল সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিষেবা। হাসপাতালে এসে পরিষেবা না পেয়ে ফিরে গিয়েছেন প্রায় সবাই। তবু শারীরিক যন্ত্রণা ভুলে রোগীদের বড় অংশেরই সমর্থন পেয়েছে আন্দোলন।

    এক তরুণী মহিলা চিকিৎসকের যে নৃশংস পরিণতি দেখে শিউরে উঠেছে সমাজ, তার জন্য ঘৃণা ছিটকে এসেছে পরিষেবা না-পাওয়া রোগীদের চোখেও। এক সপ্তাহ আগে পড়ে কোমরে ভয়াবহ চোট পেয়েছিলেন দমদম বেদিয়াপাড়ার গীতা দাস। সোমবার আরজি করের ট্রমা-কেয়ার থেকে কোনও রকমে বেরিয়ে বাড়ির পথে ৭৭ বছরের গীতা বলেন, ‘এই জঘন্য অপরাধ যারা করেছে, তাদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলুক। ক্ষমতা থাকলে আমি ডাক্তারদের সঙ্গে অবস্থানে বসতাম।’

    বাঁ চোখে ভিজে রুমাল চেপে তড়িঘড়ি ইমার্জেন্সিতে ঢুকছিলেন লেক টাউনের সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। চিকিৎসা পাননি। তবে তীব্র যন্ত্রণার মধ্যেও বলে গেলেন, ‘যতক্ষণ না অপরাধীদের প্রত্যেকে সাজা পায়, ততক্ষণ যেন এই আন্দোলন না ওঠে। আমাদের সবার বাড়িতেই মেয়ে আছে। এমন ঘটনার পরে নিজের বাড়ির মেয়েকে কি আদৌ নিরাপদ বলে মনে হয়?’

    নদিয়ার হরিণঘাটা থেকে কলকাতায় পড়তে এসেছিলেন সৃঞ্জয় দে। পাঁচ মাস আগে এপ্রিলে গলায় দড়ি দেওয়া অবস্থায় তাঁর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করা হয়। মা অমিতা এবং বাবা যদু দে-র অভিযোগ ছিল, তাঁদের একমাত্র ছেলের মৃত্যুর নেপথ্যে রয়েছে তিন বন্ধুর চক্রান্ত। এখনও পর্যন্ত সেই ঘটনায় কেউ ধরা পড়েনি। আরজি কর হাসপাতালে আন্দোলনরত চিকিৎসকদের মঞ্চে সোমবার দেখা গেল সন্তানহারা অমিতা ও যদুকেও। তাঁদের কথায়, ‘আমাদের ছেলেকে আর ফেরত পাব না। কিন্তু আর কারও কোল যেন খালি না হয়। এই আন্দোলনে আমরা আছি।’

    জুনিয়র ডাক্তারদের বেশিরভাগই কর্মবিরতি ঘোষণা করলেও পাঁচটি চিকিৎসক সংগঠনের যৌথ মঞ্চ এবং আইএমএ-র রাজ্য শাখার সিনিয়র ডাক্তাররা অবশ্য ইমার্জেন্সি পরিষেবা চালু রাখার পক্ষে মত দেন। চিকিৎসক সৌরভ দত্ত বলেন, ‘জুনিয়রদের আন্দোলনের শরিক আমরাও। পূর্ণ সমর্থন রয়েছে ওঁদের প্রতি। শুধু হাতজোড় করে একটাই অনুরোধ করবো, ইমার্জেন্সি পরিষেবাটা ওঁরা যেন কর্মবিরতি থেকে বাদ দেন। মনে রাখতে হবে, আমাদের লড়াইটা তো সাধারণ জনতার বিরুদ্ধে নয়।’

    এর পাশাপাশি রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজগুলিতে কর্মবিরতি এবং অচলাবস্থা নিয়ে এ দিনই জেলাশাসকদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করেন মুখ্যসচিব। চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সচল রাখার জন্য আলোচনা হয়। তবে পুরো বিষয়টিকে সহানুভূতির সঙ্গে দেখতে বলা হয়েছে।

    আশঙ্কাজনক অধিকাংশ রোগীদের সাধারণত কলকাতার আরজি কর হাসপাতালেই স্থানান্তরিত করেন বারাসত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আরজি কর হাসপাতালে কর্মবিরতির ফলে গত শনিবার থেকেই বন্ধ রয়েছে সেই রেফার। আশঙ্কাজনক রোগীদের কথা ভেবে সেখানে ১২টি আইসিইউ বেড বাড়ানো হয়েছে।
  • Link to this news (এই সময়)