এই সময়: আরজি কর হাসপাতালের তরুণী চিকিৎসককে খুন এবং ধর্ষণের ঘটনায় সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করেছিল কলকাতা পুলিশ। সাংবাদিক সম্মেলন করে পুলিশ কমিশনার দাবি করেছিলেন, এই নৃশংস ঘটনা ঘটিয়েছে সঞ্জয়-ই। কিন্তু প্রবল চাপের মুখে পড়ে ঘটনার তিনদিন পরে সেই তত্ত্ব থেকে কিছুটা পিছু হটে লালবাজার জানিয়ে দিল-- ওই ঘটনার সঙ্গে আর কেউ জড়িত রয়েছে কি না, অভিযুক্তকে কেউ সাহায্য বা ইন্ধন জুগিয়েছিল কি না, সেই সমস্ত সম্ভাবনাও এ বার গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।সে কারণে ওই হাসপাতালের গত ৩০ দিনের সমস্ত সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখার পাশাপাশি ঘটনার দিন ডিউটিতে থাকা সাত জন ইন্টার্ন এবং জুনিয়র চিকিৎসকের সঙ্গেও এ দিন কথা বলেন তদন্তকারী অফিসারেরা। ইতিমধ্যেই ঘটনা সম্পর্কে হাসপাতালের আউট পোস্টে থাকা পাঁচজন পুলিশ অফিসারের বয়ান নেওয়া হয়েছে। সোমবার নির্যাতিতার বাড়িতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাত দিনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার পরে বিকেলেই লালবাজারের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়, খুন এবং ধর্ষণের ঘটনার তদন্তে গঠিত বিশেষ তদন্তকারী দলে (সিট) একজন ডিসি-সহ আরও ৫ জনকে যুক্ত করা হয়েছে।
অর্থাৎ এই দলের সদস্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ১৩-তে। শুধু তাই নয়, ১৩ জন তদন্তকারীকে সাহায্য করতে তিন শিফটে আরও ৫০ জন করে পুলিশকর্মী থাকবেন। প্রায় একটি থানার সমতুল পুলিশ সংখ্যা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে কোনও তদন্তের ক্ষেত্রে এরকম সক্রিয়তা কলকাতা পুলিশের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।
রহস্যময় সেমিনার রুম
ময়নাতদন্ত এবং ইনকোয়েস্ট রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, তরুণী চিকিৎসকের গলার কণ্ঠা এবং থাইরয়েডের হাড় ভেঙে গিয়েছে। পায়ের গোড়ালির কাছে হাড়ে চিড় রয়েছে। শরীরের অন্য কোনও হাড় ভাঙা না থাকলেও বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট। গলা এবং মুখ চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে তাঁকে খুন করা হয়েছে বলে পিএম রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে।
অভিজ্ঞ পুলিশ কর্তাদের কথায়, 'দু'রকম ভাবে এই কাজ হতে পারে। এক, একাধিক ব্যক্তি সেমিনার রুমে ঢুকে খুন করেছেন। অথবা দ্বিতীয় এটাও হতে পারে সঞ্জয়কে কেউ খুনে সাহায্য করেছে।' আন্দোলনরত চিকিৎসকেরা প্রশ্ন তুলেছেন, 'অভিযুক্তকে এমন কেউ সাহায্য করেনি তো, যাঁর চিকিৎসা বিজ্ঞানে জ্ঞান রয়েছে? কারণ, বেছে বেছে সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতেই আঘাত করা হয়েছে।'
ওই তরুণী সে দিন চার তলার সেমিনার রুমে ছিলেন, সেই তথ্যই বা অভিযুক্তকে কে দিয়েছিল? সে দিন তো অন্য কেউ থাকতে পারতেন ওখানে? তা হলে কী তাঁর সঙ্গেও এমন ঘটনা ঘটতে পারত? নাকি ওই তরুণীই টার্গেট ছিলেন?' এমন নানা ধরনের প্রশ্ন তুলেছেন আন্দোলকারীরা।
এমনকী, তরুণীর মা পুলিশের কাছে 'সুপারি' দিয়ে মেয়েকে খুনের অভিযোগও করেছেন। এ দিন এক পুলিশ কর্তা বলেন, 'কোনও সম্ভাবনাই আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না। ডাক্তারদের সঙ্গে যেমন কথা বলা হচ্ছে, তেমনই আবার হাসপাতালে কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরাও আমাদের স্ক্যানারে রয়েছেন।'
লালবাজার সূত্রে খবর, এই ঘটনায় চেস্ট মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান এবং সহকারি সুপার-সহ বেশ কয়েকজনকে তলব করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, সঞ্জয়ের অতীতে কোনও অপরাধের ইতিহাস রয়েছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে সেই রিপোর্ট চলে আসতে পারে। তার পরেই আরও স্পষ্ট হবে, ওই ঘটনায় একাধিক ব্যক্তি জড়িত, নাকি তা সঞ্জয়ের একারই কাজ? শিয়ালদহ আদালতে বিচারকের অনুমতি নিয়ে এ দিন ধৃত এবং নিহত মহিলা চিকিৎসকের দু'টি মোবাইল ফোন থেকে তথ্য সংগ্রহও করা হয়েছে।
ওটির বদলে সেমিনার রুমে!
শুক্রবার সকালে ঘটনার কথা জানাজানি হওয়ার পরে তার এক পরিচিত দাদাকে চিকিৎসার জন্য আরজি করে নিয়ে যায় সঞ্জয়। ফিরে আসার পরে সংবাদ মাধ্যমে ধর্ষণ-খুনের বিষয়টি দেখার পরে সেই ব্যক্তি সঞ্জয়কে ফোন করেন। তখন সে অবাক হয়ে মন্তব্য করে, 'তাই নাকি? দেখছি কী হয়েছে?' এক বারের জন্যও কাউকে বুঝতে দেয়নি, আসলে ঘটনার নেপথ্যে সে-ই। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মুখেও এ ভাবেই ধৃত অভিযুক্ত বিভ্রান্তি বাড়াচ্ছে বলে দাবি লালবাজারের।
কেন সে সেমিনার রুমে গিয়েছিল? এই সব প্রশ্নে সঞ্জয় পুলিশের কাছে দাবি করেছে, ওই রাতে পরিচিত একজনের অস্ত্রোপচারের জন্য অপারেশন থিয়েটার কোথায় তা খুঁজতে গিয়েছিল। তখন ওই মহিলা চিকিৎসককে সেমিনার রুমে দেখতে পায়। এরপর সেখানে ঢুকে তরুণীর উপর নির্যাতন চালিয়ে খুন করে। বাইরে এসে মদ্যপান করে সকালে ৪ নম্বর ব্যাটেলিয়নে ফিরে যায় সে। শুধু এই একটি ঘটনা নয়, সঞ্জয় যে মহিলাদের সঙ্গে আগেও দুর্ব্যবহার করেছিল তারও প্রমাণ পেয়েছেন সিটের তদন্তকারীরা।
এ দিন লালবাজারে এক মহিলাকে তলব করা হয়েছিল বলে সূত্রের খবর। মাস তিনেক আগে ওই গৃহবধূ তাঁর সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সে সময়ে সঞ্জয় নিজে আলাপ করে তাঁর সঙ্গে। ওষুধ কিনে দেওয়ার নাম করে ফোন নম্বর নিয়ে বিরক্ত করা শুরু করে। এক পুলিশ কর্তার কথায়, 'ওই মহিলা আগে আমাদের কাছে অভিযোগ করেননি। তবে, এই ঘটনার বিষয়ে তাঁর সাহায্য নেওয়া হচ্ছে।'
কারও চক্ষুশূল তরুণী
আরজি কর হাসপাতালের চেষ্ট মেডিসিন বিভাগের পিজিটি হলেও, সময় বের করে অন্য হাসপাতালে গিয়ে স্বেচ্ছায় পরিষেবা দিতেন ওই তরুণী। তা অনেকেই ভালো ভাবে নিতেন না বলে অভিযোগ। ওপিডি পরিষেবা দিতে গিয়ে কোনও রোগীর কষ্ট দেখলে ছুটে যেতেন তিনি। অনেক সময়ে ওই তরুণী মাতৃসদনে গিয়েও পরিষেবা দিতেন। তদন্তকারী অফিসারেরা নিহত চিকিৎসকের সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা করছেন, এ সব কারণে ওই তরুণী কারও চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন কি না।
পুলিশের কাছে ওই তরুণীর বাবা-মা দাবি করেছেন, হাসপাতালের ডিউটি করতে ভালো লাগত না মেয়ের। বিশেষ করে রাতের দিকে। কেন এমন মনে হচ্ছিল তাঁর, কেউ দুর্ব্যবহার করছিলেন কি না এবং সেই সূত্রে ওই তরুণীর সঙ্গে কোনও 'পাশবিক' ঘটনা ঘটেছে কি না, তাও খতিয়ে দেখছে সিট। এ দিকে খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় যে বা যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়ো খবর ছড়াচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে লালবাজার।
ইতিমধ্যেই ১৫ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রয়োজনে তাঁদের নোটিস পাঠিয়ে জানতে চাওয়া হতে পারে, কোথা থেকে তারা এমন তথ্য পাচ্ছেন। এর পাশাপাশি একটি অডিয়ো ক্লিপও ভাইরাল হয়েছে এই ঘটনার প্রেক্ষিতে। তা-ও তদন্তকারীদের নজরে রয়েছে বলে লালবাজার সূত্রে খবর।