• মেয়েদের রাস্তা দখল: কেউ সংহতি জানাচ্ছেন, কেউ চুপ, একই সুরে বাজছেন না তৃণমূলের মহিলা সাংসদেরা
    আনন্দবাজার | ১৪ আগস্ট ২০২৪
  • আরজি কর-কাণ্ড তৃণমূলের ‘মহিলামহলে’ কী প্রভাব পড়ছে?

    গত দেড় দশক ধরে বাংলায় মহিলা ভোটে কার্যত একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে তৃণমূলের। বলা ভাল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দখলেই রয়েছে মহিলা ভোটের সিংহভাগ। ক্রমে তাকে পুঁজিতে পরিণত করেছে জোড়াফুল শিবির। শুধু ভোট পাওয়া নয়, পঞ্চায়েত থেকে লোকসভা, রাজ্যসভা— মহিলাদের প্রার্থী করার বিষয়েও তৃণমূল অন্য অনেক দলের চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু আরজি কর-কাণ্ডে সেই মহিলাদেরই বিরাট অংশ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে শামিল হতে চলেছেন বুধবার রাতে। মেয়েদের রাত দখলের কর্মসূচিতে অনেক জায়গায় তৃণমূলের নেতাদের পরিবারের লোকজনও জমায়েত করতে উদ্যোগী হয়ে পড়েছেন। তৃণমূলের রাজ্যসভা সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায় জানিয়েছেন, তিনি বুধবার মধ্যরাতের আন্দোলনে যোগ দেবেন।

    এই পরিস্থিতিতে কি খানিকটা চাপ বেড়েছে তৃণমূলের মহিলা সাংসদদের উপর? এর ফলে কি তৃণমূলের কার্যত ‘একচ্ছত্র পুঁজি’ মহিলা ভোটে টান পড়তে পারে? অনেকের অবশ্য বক্তব্য, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা বাড়তে থাকলে তা আর মহিলা বা পুরুষ ভোটে ভেদাভেদ করে না।

    কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র তাঁর এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্ট করে লিখেছেন, ‘আরজি করে যে ভয়াবহ অপরাধ হয়েছে তা আমাদের স্তম্ভিত করে দিচ্ছে। এই ঘটনার দ্রুত এবং স্বচ্ছ তদন্ত চাই।’ পাশাপাশিই এক্স পোস্টে ‘সংহতি’ও জানিয়েছেন মহুয়া। তবে সেই সংহতি আন্দোলনের প্রতি কি না, তা স্পষ্ট নয়। জয়নগরের তৃণমূল সাংসদ প্রতিমা মণ্ডল আবার সরাসরি আন্দোলনের ‘স্পিরিট’কে সমর্থন করেছেন। পাশাপাশিই তিনি বলেছেন, ‘‘আমি মনে করি না এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা উচিত। আমার মনে হয়, জঘন্যতম অপরাধের বিরুদ্ধেই সকলে গর্জে উঠছেন।’’ রাজ্যসভায় তৃণমূল সাংসদ সুস্মিতা দেবের কথায়, ‘‘আরজি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ করে হত্যার ঘটনা হৃদয়বিদারক। যা কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়েই বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।’’ সেই সঙ্গে সুস্মিতা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন, ‘‘নারীকল্যাণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, সেটাও বাস্তব।’’ সরাসরি আন্দোলন নিয়ে সুস্মিতা কোনও মন্তব্য করতে চাননি। এ বারই প্রথম সাংসদ হয়েছেন মিতালি বাগ। আরামবাগের এই তৃণমূল সাংসদ আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে নিজের কথা কিছু বলতে চাননি। তাঁর কথায়, ‘‘যা বলার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলে দিয়েছেন। তার উপরে আর কোনও কথা থাকতে পারে না।’’ অনেকের মতে, মিতালি প্রথম বার সাংসদ হয়েছেন। অল্প ব্যবধানে জিতেছেন আরামবাগে। তাই তিনি ‘ঝুঁকি’ নিতে চাননি। এ বারই প্রথম লোকসভায় জেতা মেদিনীপুরের সাংসদ জুন মালিয়া আবার এক্সে পোস্ট করেছেন। তাতে নিহতের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়ে জুন লিখেছেন, ‘এই জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে যাঁরা আওয়াজ তুলছেন, আমি তাঁদের প্রতি সংহতি জানাচ্ছি।’ সিবিআই দ্রুত তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ করবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন জুন।

    এ তো গেল তৃণমূলের মহিলা সাংসদদের ‘আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া’। কিন্তু মহিলা সমর্থনের বিষয়ে শাসকদলের মধ্যেই যে প্রশ্ন রয়েছে, তা একান্ত আলোচনায় মানছেন অনেক নেতা। তবে মমতার প্রতি মহিলা ভোটের সমর্থন টলমল করবে কি না, তা নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে শাসকদলের মধ্যে। তৃণমূলের একটি অংশের বক্তব্য, এখনই সামনে কোনও ভোট নেই। সূচি মেনে বিধানসভা ভোট হলে তা হবে ২০২৬ সালে। ফলে এর প্রভাব দেড় বছর পরের ভোটে পড়বে, সেটা ধরে নেওয়াটা খুব একটা বাস্তবসম্মত হবে না। তবে এর পাল্টা যুক্তিও রয়েছে। সেই অংশের বক্তব্য, তৃণমূল ১৩ বছরের বেশি সরকার চালাচ্ছে। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার সঙ্গে এই ক্ষোভগুলি জমতে থাকলে তার খেসারত দিতে হবে দলকে। কে বলতে পারে এর পরে আর কোনও ঘটনা ঘটবে না? সেই প্রসঙ্গেই তৃণমূল নেতৃত্বের অনেকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কথা উল্লেখ করছেন। এক প্রাক্তন সাংসদের বক্তব্য, ‘‘সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সময় থেকে মানুষ যে ভাবে রাস্তায় নেমেছিলেন, তা কিন্তু রিজওয়ানুর রহমান, নেতাই— সব ঘটনাতেই ধারাবাহিক ভাবে বজায় ছিল। তার ফল কী হয়েছিল সকলের জানা।’’ আশঙ্কা প্রকাশ করে ওই নেতা বলেন, ‘‘মনে রাখবেন, সেই সময়ে বিধানসভায় বামেরা ছিল একাই ২৩৫। আর বাংলা থেকে ৩৫টি সাংসদ জিতেছিল তারা।’’

    তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার বক্তব্য, ‘‘লোকসভা ভোটের মুখে সন্দেশখালির ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে কী পরিমাণ ঘৃণা ছড়ানো হয়েছিল, তা সকলের জানা আছে। কিন্তু সেই মিথ্যার পাল্টা সংগঠিত ভাবে সত্যপ্রকাশে নেমেছিল দল। লোকসভা ভোটের আগেও অনেকে ভেবে নিয়েছিলেন, মহিলা সমর্থন মমতাদির কাছ থেকে সরে যাবে। কিন্তু বাস্তবে কী হয়েছে সকলে দেখেছেন।’’ শাসকদলের এক তরুণ নেতার আবার পাল্টা যুক্তি, ‘‘এমনিতেই বাংলায় ধর্মীয়-মেরুকরণ তীব্র হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের ঘটনা যেমন এই আন্দোলনকে উৎসাহিত করছে, তেমন মেরুকরণকেও আরও সজুত করছে। এই দু’টি সমান্তরাল ভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতের জন্য তা ভাল সঙ্কেত নয়।’’ শাসকদলের অনেকে আরও একটি বিষয়কে ‘রুপোলি রেখা’ হিসেবে দেখতে চাইছেন। তা হল, যে আন্দোলন বা পথে নামার ডাক দেওয়া হয়েছে, তা সংগঠিত নয়। তাতে ‘স্বতঃস্ফূর্ততা’ থাকলেও ‘নেতৃত্ব’ নেই। ফলে এই আন্দোলন দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে শাসকদলের মধ্যে যে আলোচনার স্রোত বয়ে যাচ্ছে, তাতে কিঞ্চিৎ উদ্বেগ যে মিশে থাকবে, তাতে সন্দেহ নেই।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)