তাঁর ডাকেই পাড়ায় পাড়ায় রাত দখলে নামছেন মেয়েরা, তিনি বাম না রাম? স্পষ্ট জবাব ‘সিংহ’ রিমঝিমের
আনন্দবাজার | ১৪ আগস্ট ২০২৪
আপনি কি বুধবার মধ্যরাতে মেয়েদের রাত দখলের কর্মসূচিতে যাদবপুর এইটবি বাস স্ট্যান্ডে যাচ্ছেন? তা হলে খোঁজ করুন রিমঝিম সিংহের। তিনিই সেই কন্যা, যাঁর একটা ডাক সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়েছে। শুধু বাংলা নয়। দিল্লিস্থিত বাঙালিরা ঠিক করেছেন, ‘রাত দখলের কর্মসূচি’ তাঁরাও করবেন রাজধানীর বাঙালিটোলা চিত্তরঞ্জন পার্কে। বেঙ্গালুরু শহরের টাউন হলের সামনে জমায়েত হবেন সেখানকার বাঙালিরা।
এতটা ভেবেছিলেন রিমঝিম নিজে? বুধবার আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বললেন, ‘‘ভাবতেই পারিনি! এখন তো এত ফোন আসছে যে, আমার ফোনটাই হ্যাং করে যাচ্ছে!’’
গত ১০ অগস্ট রাতে ফেসবুকে পোস্ট করে মেয়েদের রাত দখলের আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী রিমঝিম। তাঁর কথায়, ‘‘যে কোনও ঘটনা ঘটলে কলকাতা তার একটা প্রতিবাদের বার্তা দেয়। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আমি বন্ধুবান্ধব, পরিচিতদের সঙ্গে কথা বলে ওই পোস্টটা করেছিলাম। ভেবেছিলাম পরিচিতেরা আসবেন। প্রান্তিকলিঙ্গ যৌনতার কিছু মানুষ আসবেন। কিন্তু তা যে এই আকার নেবে, তা ধারণার মধ্যেও ছিল না।’’ সমাজবিদ্যার ছাত্রী ছিলেন রিমঝিম। এখন গবেষণা করছেন। বিষয়: গৃহশ্রমিক। বাড়িতে অবসরপ্রাপ্ত বাবা এবং মা। মেয়ে যে ‘নেত্রী’ হয়ে উঠলেন, তা দেখে বাবা-মা কী বলছেন? হাসতে হাসতে রিমঝিম বললেন, ‘‘না-না, আমি নেত্রী নই। তবে হ্যাঁ, এত মানুষ সাড়া দিচ্ছেন দেখে বাবা-মা খুশি।’’ কলকাতার যে আবাসনে রিমঝিম থাকেন, সেখানকার আবাসিকেরা এসেও তাঁকে বলেছেন, ‘‘তুই দারুণ উদ্যোগ নিয়েছিস!’’
রিমঝিম প্রথম যে ডাক দিয়েছিলেন, তাতে যাদবপুর এইটবি বাস স্ট্যান্ডের সামনে জমায়েতের কথা বলা হয়েছিল। পরে তা বেড়ে হয় তিনটি এলাকা। যুক্ত হয় অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস চত্বর এবং কলেজ স্ট্রিট। কিন্তু সেই তিন এখন ৩০০ পেরিয়ে গিয়েছে। যদিও রিমঝিম বলছেন, বিভিন্ন জেলার ৬০-৭০টি জায়গা থেকে স্থানীয়েরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজেদের এলাকায় কর্মসূচি ঠিক করেছেন। তাঁর ডাক দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বাংলা জুড়ে। একটি জেলার এক একটি পুরসভা এলাকায় একাধিক জায়গায় জমায়েতের উদ্যোগ নিয়েছেন স্থানীয়েরা। শুধুমাত্র স্বাধীনতা দিবসের রাতে মেয়েদের ওই কর্মসূচি ঘিরে তৈরি হয়েছে শত শত হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপ!
আরজি কর হাসপাতালের চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় তোলপাড় রাজ্য। সেই প্রেক্ষাপটেই প্রতিবাদের ডাক দিয়েছিলেন রিমঝিম। তাঁর কথায়, ‘‘যখন দেখলাম প্রিন্সিপালের বক্তব্য ছিল, কেন ওই মহিলা চিকিৎসক এত রাতে সেমিনার রুমে গিয়েছিলেন, তখনই ভাবলাম প্রতিবাদ করা উচিত। আমিও তো কত সময়ে পড়ে, কাজ সেরে অনেক রাতে বাড়ি ফিরি।’’ কেন এক জন কর্তব্যরত মহিলা চিকিৎসককে সেমিনার রুমে বিশ্রাম নিতে হবে, কেন সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো থাকবে না, সেই প্রশ্ন তুলে রিমঝিম বলেছেন, আসল বিষয়টি ‘লঘু’ হয়ে যাচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘নারীদের স্বাধীনতা নারীদেরই বুঝে নিতে হবে।’’
প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময়ে সে ভাবে সরাসরি ছাত্র সংগঠন করেননি রিমঝিম। তবে বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে যখনই আন্দোলন হয়েছে, তিনি সঙ্গে থেকেছেন। তাঁরই দুই বান্ধবী ‘মি-টু’ অভিযোগ এনেছিলেন। রিমঝিম লড়েছিলেন তাঁদের হয়ে। ২০১৮ সালে সাইবারাবাদে এক চিকিৎসককে খুন করে পুড়িয়ে মারার ঘটনার পরেও যাদবপুর এইট বি-তে রাতে কর্মসূচি করেছিলেন রিমঝিমেরা। সেটা ছিল নিতান্তই ‘প্রতীকী’। বেশি লোকও আসেননি। এ বার আর তা ‘প্রতীকী’ নেই।
শাসকদলের অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, মহিলাদের রাত দখলের কর্মসূচিতে ‘বাম-রাম’ যোগ রয়েছে। রিমঝিম কি রাম? না কি তিনি বাম? প্রশ্ন শুনে হাসতে হাসতে রিমঝিম বললেন, ‘‘অনেকে তো বলছে আমি বিজেপির নেতাদের ফোন করে ডাকছি। বিশ্বাস করুন, সংসদীয় গণতন্ত্রে রয়েছে, এমন কোনও রাজনৈতিক দলের উপর আমার আস্থা নেই। আমরা সিপিএমের শাসন জানি, আমরা তৃণমূলের জমানাও দেখছি। আমরা বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির কথাও জানি।’’ তা হলে কেন এই রাজনৈতিক অভিযোগ? রাত দখলের আহ্বায়ক বলেন, ‘‘চলতি ব্যবস্থা যদি দেখে পাল্টা কোনও অভিমত শক্তিশালী হয়ে উঠছে, তখন তারা এটা বলবেই।’’ নিন্দকদের কথা রিমঝিম গায়ে মাখছেন না।
নারী স্বাধীনতা কী, পরিকাঠামো কী হওয়া উচিত, সে সব নিয়ে রিমঝিমের সুর্নিদিষ্ট বক্তব্য রয়েছে। সেই বক্তব্য শুনতে যদি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কখনও তাঁকে ডাকেন? সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলির উপর ‘অনাস্থা’ থাকলেও রিমঝিম জানিয়েছেন, তিনি যাবেন। গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন। সঙ্গে এ-ও বলছেন, মমতার রাজনীতির নানা সিদ্ধান্তের সঙ্গে তিনি একমত নন। যেমন নন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজনীতির সঙ্গে। যেমন ছিলেন না সদ্যপ্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গেও।
বুধবার দুপুরে রিমঝিম অবশ্য ব্যস্ত রাত দখলের কর্মসূচি নিয়ে। তাঁকে পৌঁছতে হবে যাদবপুরের ‘দলহীন-ঝান্ডাবিহীন’ কর্মসূচিতে। ফোন আসছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। বার বার হ্যাং করে যাচ্ছে ফোন।