• লণ্ঠনের আলোয় রচিত তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের রূপরেখা
    বর্তমান | ১৫ আগস্ট ২০২৪
  • শ্রীকান্ত পড়্যা, তমলুক: ‘‘আসমুদ্র হিমাচল, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা, পেশোয়ার, ইম্ফল সমগ্র ভারতবর্ষ আমাদের দেশমাতৃকা। তারই সামান্য অঙ্গ-ক্ষুদ্র জনপদ তমলুক মহকুমা। তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার তারই খণ্ড অংশমাত্র…আমি সতীশচন্দ্র সামন্ত, সর্বাধিনায়কের কার্যভার গ্রহণ করলাম। মহা-সত্যের মত মাথার উপর আলো ছড়াক শুক্লা একাদশীর চাঁদ।’’

    ১৯৪২ সালের ১৭ডিসেম্বর। অঘ্রাণের শেষ। পৌষের শুরু। বৃহস্পতিবার।  জ্যোৎস্না ধোয়া নিস্তব্ধ শীতের রাত। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্রান্তিকাল। এরকম এক নিঝুম রাতে তমলুকের দক্ষিণ নারকেলদা গ্রামে মহেন্দ্রনাথ দোলাইয়ের মুদি দোকানের দোতলায় চাটাই পেতে বসে আছেন অজয়কুমার মুখোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র সামন্ত ও সুশীলকুমার ধাড়া। ঘরের মধ্যে ঢেকে রাখা লণ্ঠনের টিমটিমে আলো। এরকম এক মুহূর্তে এই জায়গাতেই রচিত হয়েছিল তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের উজ্জ্বল রূপরেখা। সেই স্মৃতির সরণি বেয়েই দক্ষিণ নারিকেলদা সংলগ্ন নিমতৌড়িতে গড়ে ওঠে ‘স্মৃতিসৌধ’।

    কোন প্রেক্ষাপটে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার তৈরি হয়েছিল? এটা জানা প্রয়োজন। ১৯৪২সালের ৮আগস্ট গভীর রাতে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি বোম্বাই অধিবেশনে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন প্রস্তাব গ্রহণ করে। ভোর না হতে গান্ধীজি সহ শীর্ষ কংগ্রেস নেতৃত্বকে গ্রেপ্তার করা হয়। গান্ধিজি ডাক দিলেন ‘ডু আর ডাই’। এই আহ্বানে উদ্বেল হয়ে উঠল তমলুক ও কাঁথি মহকুমা। ২৯সেপ্টেম্বর তমলুক, সুতাহাটা, মহিষাদল, নন্দীগ্রাম ও ময়না থানা দখল নিতে হাজার হাজার মানুষের মিছিল এগিয়ে চলে। তমলুক শহরের পাঁচটি প্রবেশপথ দিয়ে পাঁচটি জনতার মিছিল থানার দিকে এগোয়। অপরদিকে, থানা অভিযান রুখতে পুলিস ও সৈন্যবাহিনী প্রতিটি জায়গায় কর্ডন করে ফেলে। পশ্চিম দিক থেকে আট হাজার স্বেচ্ছাসেবক মিছিল থানার কাছাকাছি পৌঁছতেই দারোগা মনীন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর নির্দেশে লাঠিচার্জ শুরু হয়। পরক্ষণেই গুলি। তাতে শহিদ হন রামচন্দ্র বেরা, বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী ও ভূষণচন্দ্র জানা। 

    উত্তর দিক থেকে ৭৩বছর বয়সী মাতঙ্গিনী হাজরার নেতৃত্বে অপর একটি মিছিল এগিয়ে যায়। পুলিস অফিসার অনিল ভট্টাচার্য মিছিলের গতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়ে গুলির নির্দেশ দেন। শহিদ হন মাতঙ্গিনী হাজরা, লক্ষ্মীনারায়ণ দাস, পুরীমাধব প্রামাণিক, নগেন্দ্রনাথ সামন্ত ও জীবনকৃষ্ণ বেরা। তবুও জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত। দক্ষিণ দিক থেকে মিছিল এগিয়ে চলে। স্বেচ্ছাসেবকদের উপর গুলি চলে। তাতে শহিদ হন নিরঞ্জন জানা, পূর্ণচন্দ্র মাইতি। শহিদদের রক্তে লাল হল তমলুকের মাটি। রচিত হল আত্মবলিদানের এক নতুন ইতিহাস। তার মধ্যমণি শহিদ মাতঙ্গিনী হাজরা। ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর রক্তস্নানের মধ্যে দিয়ে যে বিপ্লবের সূচনা, ১৭ডিসেম্বর তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তা পরিণতি লাভ করে। 

    ১৬অক্টোবর প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা পরিস্থিতিতে তমলুক ও কাঁথি মহকুমা যেন শ্মশান ভূমিতে পরিণত হয়। একদিকে, দুর্ভিক্ষ থাবা বসিয়েছে। গ্রামে গ্রামে মহামারী মড়ক। বাজার অগ্নিমূল্য। চাল উধাও। গরম ভাত নয়, ফ্যান দাও বলে হাহাকার করছে মানুষ। কুকুর-বিড়ালের সঙ্গে মানুষের তফাত বোঝা দায়। আর এক দিকে, ইংরেজ শাসনকে পঙ্গু দেওয়ার লক্ষ্যে এক উদগ্র সংগ্রাম। ব্রিটিশ শাসনে এটি ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সমান্তরাল জাতীয় সরকার। প্রথম সর্বাধিনায়ক হন বিপ্লবী সতীশচন্দ্র সামন্ত। এই সরকার শুধুমাত্র নামসর্বস্ব জাতীয় সরকার ছিল না। দীর্ঘ একুশ মাস তমলুক, মহিষাদল, নন্দীগ্রাম, সুতাহাটায় অপ্রতিহত প্রভাব এবং বিপুল জনসমর্থন পেয়েছিল। এই জাতীয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ছিল। স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, শিক্ষা, বিচার, কৃষি, তথ্য ও প্রচার বিভাগ। প্রতিটি বিভাগের দায়িত্বে একজন মন্ত্রী ছিলেন। সর্বাধিনায়ক অন্যান্য মন্ত্রীদের সাহায্যে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। প্রতিটি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তদের দক্ষতা, যোগ্যতা, দেশপ্রেম জাতীয় সরকারকে জনগনের কাছে প্রিয় করে তুলেছিল। 

    ১৯৪৪সালের আগস্ট মাসে গান্ধীজি ভারতছাড়ো আন্দোলনের অবসান ঘোষণা করেন। একুশ মাস বাদে সরকারের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি যখন মধ্যগগনে তখন গান্ধীজির নির্দেশে এই সরকার স্বেচ্ছায় আত্মবিলুপ্তি ঘোষণা করে। ১ সেপ্টেম্বর থেকে জাতীয় সরকারের সব কাজকর্ম বন্ধ রাখার কথা ঘোষণা করা হয়। বিদ্যুৎ বাহিনী ভেঙে দেওয়া হয়। গান্ধীজির নির্দেশে দেড়শো কর্মী ইংরেজ সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এইভাবে মেদিনীপুরে জাতীয় সংগ্রামের একটি রক্তাক্ত অধ্যায় শেষ হল। বিয়াল্লিশের আন্দোলন মেজাজের দিক থেকে আগের সব আন্দোলনের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। শত শত নাম না জানা মানুষের আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কাহিনী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই আন্দোলনকে স্থায়ী মর্যাদা দান করেছে। এই স্বতঃস্ফূর্ত গণসংগ্রাম ব্রিটিশ শক্তিকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, ভারতে শাসকের দিন ফুরিয়ে এসেছে। এই আন্দোলনের পাঁচ বছর পর তারা ভারত ভূমি ত্যাগ করে। -নিজস্ব চিত্র
  • Link to this news (বর্তমান)