• ‘ভারত ছাড়ো’ স্লোগানের জন্ম জলপাইগুড়ির মাটিতে সভায় ছিলেন নেতাজি, শরৎচন্দ্র
    বর্তমান | ১৫ আগস্ট ২০২৪
  • ব্রতীন দাস, জলপাইগুড়ি: তখন শীতকাল। কিন্তু, উত্তাপ ছড়াচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বারুদ-বাতাস। ঠিক এমনই আবহে জলপাইগুড়ির মাটিতে পা রাখলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। 

    দিনটা ১৯৩৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। দার্জিলিং মেল এসে থামল জলপাইগুড়ি টাউন স্টেশনে। বেরিয়ে এলেন দেশনায়ক। জাতীয় কংগ্রেসের কর্মীরা তাঁকে নিয়ে গেলেন শহরের পান্ডাপাড়ার মাঠে। আগে থেকেই সেখানে তৈরি ছিল বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের মঞ্চ। তিনদিনের সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন ঘড়ির কাঁটায় রাত তখন ৮টা। মঞ্চে মাইক ধরলেন সুভাষ। দিলেন ঐতিহাসিক বক্তৃতা। ঘোষণা করলেন, ‘ছ’মাসের চরম সময়সীমা দেওয়া হল। এর মধ্যে ইংরেজ তোমাকে ভারত ছাড়তে হবে।’ জন্ম নিল ‘ইংরেজ তুমি ভারত ছাড়ো’ স্লোগান। পরে সেই স্লোগানকেই গান্ধীজি সর্বভারতীয় রূপ দিয়েছিলেন, বলছেন জলপাইগুড়ির বাসিন্দা তথা উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রাক্তন অধ্যাপক আনন্দগোপাল ঘোষ। 

    জলপাইগুড়ির সঙ্গে নেতাজির যোগাযোগ ঐতিহাসিক। তখন মঞ্চে বসে সুভাষের দাদা তথা অধিবেশনের সভাপতি শরৎচন্দ্র বসু। ছিলেন কুমিল্লার জননেতা আশরাফউদ্দিন চৌধুরী। নেতাজি ভাষণ শেষ করতেই জানতে পারলেন, ত্রিপুরী কংগ্রেসে জাতীয় সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। 

    বর্তমানে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির মধ্যে একমাত্র জলপাইগুড়িতেই প্রাদেশিক সম্মেলনের অধিবেশন বসেছিল। আয়োজনের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন খগেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ও চারুচন্দ্র সান্যাল। ১৯৩৮ সালে বিষ্ণুপুরে যখন প্রাদেশিক সম্মেলন হয়, তখনই জলপাইগুড়িতে অধিবেশনের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন খগেন্দ্রনাথ। সেসময় জলপাইগুড়ি বলতে ছিল চা শিল্পপতিদের শহর। বেশিরভাগই ইউরোপীয়। তাছাড়া তখন জলপাইগুড়ি নন রেগুলেটেড ডিস্ট্রিক্টের সদর দপ্তর। গোটা ডুয়ার্সই নন রেগুলেটেড ডিস্ট্রিক্টের অধীনে। এখানে নিষিদ্ধ ছিল সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক কার্যাকলাপ। কেউ অমান্য করলে ২৪ ঘণ্টার নোটিসে নির্বাসনে পাঠানো যেত তাঁকে। কিন্তু, এসব উপেক্ষা করেই সেদিন জলপাইগুড়ির মাটিতে প্রাদেশিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন চারুচন্দ্র, খগেন্দ্রনাথরা। অধিবেশনের জন্য গড়া হয়েছিল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। তার অধিনায়ক ছিলেন শশধর কর। 

    সম্মেলন উপলক্ষ্যে জলপাইগুড়ির পান্ডাপাড়ার মাঠে গড়ে তোলা হয়েছিল বিরাট নগরী। নগরসজ্জা ও তোরণ নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন নন্দলাল বসুর ছাত্র শিল্পী প্রভাতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। অধিবেশনের পাশাপাশি আয়োজন করা হয়েছিল শিল্প প্রদর্শনী। যার উদ্বোধন করেন ডাঃ সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় ও লীলা রায়ের। এই লীলা পরে দেশনেত্রী হন। অধিবেশনের বিশেষ দিক, বিপুল সংখ্যায় যোগ দিয়েছিলেন মুসলমান, নেপালি ও মহিলারা। যে পাড়ায় অধিবেশন হয়, পরে তার নাম হয়ে যায় কংগ্রেসপাড়া। সুভাষের স্মৃতি বিজড়িত সেই রেলস্টেশন, সেই মাঠ আজও ইতিহাস-সাক্ষী। 

    গবেষক আনন্দগোপাল ঘোষ বলছেন, জলপাইগুড়ির মাটিতে দাঁড়িয়ে সুভাষচন্দ্র ইংরেজদের চরম হুঁশিয়ারি দেওয়ার পাশাপাশি নেপালি তথা গোর্খা সম্প্রদায়ের উদ্দেশে অত্যন্ত মূল্যবান বক্তব্য রেখেছিলেন। বলেছিলেন, ‘১৯২২ সালে যে আন্দোলন ভারতের পল্লিতে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার প্রভাব গোর্খা সম্প্রদায়ের মধ্যেও প্রবেশ করেছিল। দলবাহাদুর গিরির মতো নির্ভিক স্বদেশপ্রেমিক বাংলাদেশে খুব কম দেখেছি আমি।’ আনন্দবাবুর কথায়, জলপাইগুড়ির ওই অধিবেশনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল সুদূরপ্রসারী। যা স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মসূচিতে দিক নির্দেশ করে। জলপাইগুড়ির পর প্রাদেশিক সম্মেলনের আর একটি অধিবেশনই হয়েছিল ঢাকায়। তারপর আর হয়নি। সম্ভবও ছিল না। কারণ তারপর গোটা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে। সে অন্য অধ্যায়। 
  • Link to this news (বর্তমান)