• ব্রিটিশ শাসনে প্রথম অস্ত্র আইনে কারাদণ্ড হয়েছিল নলহাটির দুকড়িবালাদেবীর
    বর্তমান | ১৬ আগস্ট ২০২৪
  • বলরাম দত্তবণিক, নলহাটি: প্রতিবছর ঘটা করে স্বাধীনতা দিবস পালন হয়। কিন্তু অনেকেই জানেন না বীরভূমের অগ্নিকন্যা দুকড়িবালা দেবীকে। এই সাদামাটা লেখাপড়া না জানা মহিলা সাধারণ ছিলেন না। ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন নারী বিপ্লবী। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে ‘মাসিমা’ নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর বাড়ি হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গোপন ডেরা। ব্রিটিশ শাসনকালে দুকড়িবালা দেবী অস্ত্র আইনে প্রথম সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত মহিলা।

    বীরভূমের নলহাটিতে একদিকে তীরপিতা নদী, অন্যদিকে ব্রাহ্মণী। মাঝখানে  দ্বীপের মতো ঝাউপাড়া গ্রাম। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুলাই এই গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেন দুকড়িবালাদেবী। তাঁর বোনপো রানিগঞ্জের সিয়ারসোল গ্রামের নিবারণচন্দ্র ঘটক সরাসরি স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সিয়ারসোল গ্রামে সেইসময় যুগান্তর দলের একটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। সংগঠনের মাথা ছিলেন নিবারণ। বোনপোর টানে প্রায়ই সিয়ারসোলে আসতেন দুকড়িবালাদেবী। বোনপোর সঙ্গে জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ, বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো নামকরা বিপ্লবীদের কার্যকলাপে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনিও নেমে পড়েন স্বাধীনতা সংগ্রামে। এই নিবারণ ঘটকই স্বদেশী আন্দোলনকারীদের জন্য গোপন ডেরা হিসেবে মাসিমার বাড়ি ও ঝাউপাড়াকে বেছে নিয়েছিলেন। বিপ্লবী বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায়, ক্ষুদিরাম বসু, মাস্টারদা সূর্যসেন এই বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকতেন। দুকড়িবালাদেবী, নিবারণ ঘটকের বিপ্লবী কার্যকলাপ সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় সৌরেন্দ্রকুমার চক্রবর্তীর লেখা ‘শেকল ভাঙার পণ ও বাংলার মেয়ে দুকড়িবালা’ শীর্ষক গ্রন্থে। স্বগীয় সৌরেন্দ্রকুমার চক্রবর্তী দুকড়িবালাদেবীর ছেলে।

    ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর জার্মানির রডা কোম্পানির মাওজার পিস্তল ও গোলাবারুদ স্টিলের ট্যাঙ্কের মধ্যে ভরে গোরুর গাড়ি করে ফোর্ট উইলিয়াম ক্যান্টনমেন্টে আসছিল। এই অস্ত্র আনার জন্য বেশ কয়েকটি গোরুর গাড়ির প্রয়োজন হয়েছিল ব্রিটিশদের। যার মধ্যে একটি গোরুর গাড়ির গাড়োয়ানের ছদ্মবেশে বিপ্লবী হরিদাস দত্ত ৯ বাক্স কার্তুজ ও ৫০টি পিস্তল চুরি করে পাচার করেন চন্দননগরের গোন্দলপাড়ার ক্ষেত্রবাবুর বাড়িতে গোপন আস্তানায়। যাতে নাম জড়ায় নিবারণ ঘটক ও বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায়ের। তাঁরা আত্মগোপন করেন। ১৯১৭ সালের জানুয়ারির শুরুতে মুরারিপুকুর ডাকাতি মামলায় ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন বিপিনবিহারী। লুট করা অস্ত্র বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে নিবারণের উপর। তিনি সেগুলি রেখে আসেন হাওড়ার বিপ্লবী অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছে। তল্লাশির ভয়ে সেখান থেকে আটটি মাওজার পিস্তল এবং দুটি বাক্সভর্তি গুলি নিয়ে নলহাটিতে  মাসিমার বাড়িতে আসেন। পরের দিনই রণেন গঙ্গোপাধ্যায় এবং অনুকূলচন্দ্র নিয়ে আসেন আরও কিছু কার্তুজ এবং পিস্তল। সেগুলি লুকিয়ে রাখার দায়িত্ব ছিল মাসিমার উপর। দুকড়িবালাদেবী সেগুলি বাড়ির ওঠানো থাকা খড়ের পালুইয়ে লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু কোনওভাবে সেই খবর পৌঁছয় ব্রিটিশদের কাছে। ১৯১৭ সালের ৭ জানুয়ারি ভোররাতে ব্রিটিশ পুলিস দলবল নিয়ে মাসিমার বাড়ি ঘিরে ফেলেন।

    সেদিনের রাতের সেই কাহিনি বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন দুকড়িবালাদেবীর বছর একষট্টির নাতবউ দেবী চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ঠাকুমা অত্যন্ত সাহসী ছিলেন। ভারী বুটের আওয়াজ শুনেও ভয় পাননি। ওই রাতে দরজা খোলার জন্য বলে পুলিস। ঠাকুমা বলেন ঘরে পুরুষ নেই। ছোট ছেলেপুলে নিয়ে একা রয়েছি। সকাল হলে দরজা খুলবে। এরই মধ্যে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তিনি পাশের সুরধনী মোল্লানির বাড়িতে অস্ত্রগুলি পাচার করে দেন। এক গ্রামবাসী তা দেখে ফেলেন। এদিকে দরজায় লাথি মারতে থাকে পুলিস। পরে দরজা খুলে দিলে পুলিস গোটা ঘরে তন্নতন্ন করে তল্লাশি চালায়। নষ্ট করে দেওয়া হয় বই, কাগজপত্র ও খাদ্য সামগ্রী। অস্ত্র না পেয়ে পুলিস যখন চলে যাচ্ছে তখন গ্রামের ওই বাসিন্দা টাকার বিনিময়ে সুরধনীর বাড়ি ইশারা করে দেখিয়ে দিলে অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিস। গ্রেপ্তার করা হয় দুকড়িবালাদেবী ও সুরধনীকে। দুড়কিবালাদেবীর দু’বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। জামিন পান সুরধনী। দুকড়িবালাদেবীকে পাঠানো হয় প্রেসিডেন্সি জেলে। তিনিই পরাধীন ভারতের প্রথম মহিলা যিনি অস্ত্র আইনে দণ্ডিত হয়েছিলেন।

    তবে এখনও পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে মহিলা বিপ্লবী দুকড়িবালাদেবীকে যোগ্য সম্মান না জানানোয় আক্ষেপ রয়েছে তাঁর ৭১ বছরের নাতি পার্থসারথী চক্রবর্তীর। তিনি বলেন, ঠাকুমার নামে তেমন কোনও নিদর্শন নেই। শুধুমাত্র তাঁরই জমিতে গড়ে ওঠা প্রাথমিক বিদ্যালয় দুকড়িবালা ও নিবারণ ঘটকের নামে নামাঙ্কিত। জেলায় তাঁর নামে আবক্ষ মূর্তি স্থাপন ও ঝাউপাড়া থেকে বেরনোর ব্রাহ্মণী নদীর উপর ব্রিজ করা হোক। ব্রিজের নামকরণ করা হোক ঠাকুমার নামে। তাহলে নতুন প্রজন্ম এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর সম্পর্কে জানতে পারবেন। তেমনই তাঁদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ গড়ে উঠবে। একই দাবি গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য তথা তৃণমূল নেতা কৈলাশ লেটেরও।
  • Link to this news (বর্তমান)