• হাসপাতালের উপর রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব কমলে, নিরাপত্তার বিষয়টি জোরদার করা সম্ভব
    হিন্দুস্তান টাইমস | ১৭ আগস্ট ২০২৪
  • আরজি কর হাসপাতালের ঘটনা নতুন করে কয়েকটি বিষয় নিয়ে ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। একদিকে যেমন উঠছে হাসপাতালে চিকিৎসক এবং চিকিৎসা কর্মীদের নিরাপত্তার প্রশ্ন, তেমনই অন্য দিকে উঠছে কর্তৃপক্ষের ভূমিকার প্রশ্নও।

    হাসপাতালে রোগী মৃত্যুর ঘটনা যখন ঘটে, তখন চিকিৎসায় গাফিলতির প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু সব সময় তো চিকিৎসায় গাফিলতি হয় না। কিন্তু এখানকার বহু মানুষের একটা ধারণাই হচ্ছে, হাসপাতালে রোগীমৃত্যু মানেই চিকিৎসায় গাফিলতি। আর এমন কিছু ঘটলেঅ দেখা যায়, রোগীর বাড়ির লোকজন হাসপাতালে ঢুকে পড়েন এবং হাঙ্গামার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যায়। আর এই ধরনের বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। কখনও আবার এর সঙ্গে জুড়ে যায় রাজনীতিও। ছোট বা মাঝারি রাজনৈতিক নেতারা হাসপাতালে চড়াও হয়ে যান। ফলে পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থাটাই নামকে বাস্তে হয়ে দাঁড়ায়। কারা হাসপাতালে ঢুকতে পারবেন, কারা পারবেন না— সেটার উপর কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আর নিরীহ রোগীর বাড়ির লোকজন সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় পড়েন।

    আর একটি কথা বলা দরকার। হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগ হল সবচেয়ে উন্মুক্ত এবং নিরাপত্তা বিহীন। সেখানেই সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা দেওয়ার দরকার। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এখানে রোগীকে আনাই হয়েছে মৃত, তাদের মৃত বলে ঘোষণা করলেই অশান্তি তৈরি হয়। এই ব্যবস্থা সামাল দেওয়ার মতো নিরাপত্তাব্যবস্থা বহু হাসপাতালেই নেই।

    রাতে হাসপাতালে মেয়েদের নিরাপত্তার প্রশ্নটিও উঠেছে এর মধ্যে। বর্তমান ঘটনার প্রেক্ষিতে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, রাতে যাঁরা ডিউটি করবেন, তাঁরা ঘুমোবেন কেন? সেক্ষেত্রে উত্তর হল, টানা ২৪ ঘণ্টা, ৩৬ ঘণ্টা ডিউটি করলে মানুষ তো ক্লান্ত হবেই। অথবা যদি ১২ ঘণ্টারও ডিউটি হয়, তাহলে কেউ তো টানা ১২ ঘণ্টা কাজ করতে পারেন না। বহু হাসপাতালেই চিকিৎসকদের বসার বা বিশ্রাম নেওয়ার মতো সঠিক পরিকাঠামো নেই। শুধু সরকারি হাসপাতাল কেন, বহু বেসরকারি ছোট হাসপাতালেও একই ছবি।

    এর মধ্যে আরজি করেও দুষ্কৃতীরা চড়াও হয়েছিল ইমার্জেন্সি বিভাগে। সেটি ব্যাপক ভাঙচুর হয়েছে। কারণ এই বিভাগটি এমন জায়গায় থাকে, যাতে বেশির ভাগ মানুষ সহজে এটি অ্যাকসেস করতে পারেন। এক্ষেত্রে এই অ্যাকসেসটা শুধু রোগীদের জন্য হওয়া উচিত। কিন্তু দেখা যায়, যার ইচ্ছা, সেই ঢুকে পড়তে পারে এখানে। আর এই কারণেই বেশির ভাগ সরকারি হাসপাতালের নিরাপত্তার ফাটলের প্রথম পথটাই হয়ে যায় এই ইমার্জেন্সি বিভাগ।

    আরও একটি কথা মনে রাখা দরকার। সরকারি হাসপাতালে গ্রাম থেকে বহু রোগী আসেন। তাদের বাড়ির লোকজন হাসপাতাল চত্বরেই থেকে যান। বাড়ি বা হোটেল ভাড়া করার মতো অর্থ থাকে না তাঁদের কাছে। আর তাঁরা বহু অসাধু মানুষের খুব সহজ নিশানা হয়ে যান। তাঁদের থেকে টাকা নেওয়া হয়, আরও নানা ভাবে তাঁদের ফাঁসানো হয়।

    এবার আসা যাক আলাদা করে মহিলাদের নিরাপত্তার প্রশ্নে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা মহিলা চিকিৎসক এবং চিকিৎসাকর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু আমরা কি এক বার প্রশ্ন তুলছি এই সব হাসপাতালের ফিমেল ওয়ার্ডের নিরাপত্তা নিয়ে? একজন রোগী খুব খারাপ অবস্থাতেই হাসপাতালে ভর্তি হন। সেই সময়ে তাঁর সঙ্গে কোনও দুষ্কর্ম হলে, তাঁদের অনেকেরই হয়তো বাধা দেওয়ার ক্ষমতা থাকে না। ফলে সেই নিরাপত্তার কথাও ভাবতে হবে। সেখানে পর্যাপ্ত মহিলা নিরাপত্তাকর্মী আছেন কি না, সেটাও ভাবতে হবে। হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যক্ষেত্র হচ্ছে এমন একটি জায়গা, যেখানে নারী এবং পুরুষ সমান সংখ্যায় আসেন, তাঁদের সবাইকে সঠিক নিরাপত্তা আমরা দিতে পারছি কি না, তার প্রশ্ন এই পরিস্থিতিতে উঠবেই।

    এবার আলাদা করে আরজি করের কথায় আসা যাক। যখন একটা ঘটনা ঘটে, তখন আলাদা করে চোখে আঙুল দিয়ে সেই ঘটনাটা আমাদের দেখানো হয়। এক্ষেত্রেও বিষয়টা কিছুটা তাই হয়েছে। আমি নিজে আরজি করে কাজ করিনি। কিন্তু আমার বন্ধু এবং সহকর্মীদের থেকে যা শুনেছি, এবং অন্যান্য সরকারি হাসপাতাল সম্পর্কেও আমার যা জ্ঞান, তাতে একটা কথা প্রথমেই বলতে হবে। প্রতিটি হাসপাতালের প্রবেশের পথ একাধিক। কোনও চেক পয়েন্ট নেই সেভাবে। ন্যাশনাল, পিজি, ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজেও বহু মানুষ ঢুকে পড়েন। এমনকী বহু ক্ষেত্রে তাঁদের উদ্দেশ্যও খুব একটা সাধু হয় না। এটায় লাগাম টানাটাই আসল কথা।

    একজন রোগী হাসপাতালে এলে, তাঁর সঙ্গে কত জন মানুষকে হাসপাতালে ঢুকতে দেওয়া হবে, সেটিরও স্পষ্ট নিয়ম থাকা দরকার। বর্তমান ঘটনায় একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শোনা গিয়েছে, তিনি একজন সিভিক ভলান্টিয়ার। এমন লোক হঠাৎ হাসপাতালে ঢুকলেন কী করে, তাঁর হাতে নিরাপত্তার দায়িত্ব কি ছিল— এই প্রশ্নগুলি তোলাই হল আসল কথা।

    একজন মানুষ যখন হাসপাকালে যান, তখন তাঁর প্রায় কোনও আব্রু থাকে না। আর সেই সময়ে তিনি আক্রান্ত হলে, বাধা দেওয়ার ন্যূনতম ক্ষমতাও তাঁর না থাকতে পারে। তখন সেই মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্ব যাঁদের উপর ন্যাস্ত হচ্ছে, তাঁরাও কতটা নির্ভরযোগ্য, সেটিরও স্ক্রিনিং হওয়া দরকার।

    বিদেশে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে কাজ করার সময়ে দেখেছি, ওখানকার ইমার্জেন্সি বিভাগে কোনও পুলিশ থাকে না। কিন্তু ওখানে সাধারণ মানুষই অনেক বিষয়ে খুব সচেতন। কিন্তু এখানে বিষয়টা তার ঠিক উলটো। তার পাশাপাশি আর একটি জিনিসও ঘটেছে। মোটামুটি সকলেই বুঝে গিয়েছেন, নিজের রাগ দেখাতে গিয়ে হাসপাতালে একটু ভাঙচুর করলে কোনও সাজা হবে না। এটাকে সমূলে বিনাশ করলে তবেই নিরাপত্তার বিষয়টি সুনিশ্চিত করা যাবে। মানুষের আবেগ তো থাকবেই, বিশেষ করে যেখানে জীবন-মরণের প্রশ্ন, সেখানে আবেগ থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেখানে তো যা খুশি তাই করা যায় না।

    আরও একটি কথা বলার আছে। এই অব্যবস্থার কারণেই রোগের ঠিকঠাক পর্যালোচনাতেও বাধা পড়ে। বিদেশে কোনও রোগীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে নির্দিষ্ট করোনার সিস্টেম রয়েছে, সেটি দেখার জন্য। আমাদের এখানে সেগুলি আছে বটে, কিন্তু কার্যকর নয়। তার উপর বসে যায় খাপ পঞ্চায়েত। ফলে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীরা হয়ে যান সফ্ট টার্গেট। কাউকে একটা কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর প্রবণতা রয়েছেই। সেটারই মুখে পড়েন চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীরা।

    সরকারি হাসপাতালে বেড পাওয়ার জন্য অনেকেই রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের সাহায্য নেন। দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রেই যে রোগীর আসলে বেড দরকার, তাঁর জায়গায় অন্য কেউ এই সুপারিশের দৌলতে বেড পেয়ে যান। আর এই বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ না করা গেলেই সরকারি হাসপাতালে লুম্পেনদের প্রভাব কমবে না।

    শেষ কথা বলব, আরজি করের অবস্থা আগে এতটা খারাপ ছিল না। যাঁরা এই হাসপাতালে পড়াশোনা করেছেন, এমন অনেক বন্ধুর থেকেই শুনেছি, আরজি করের পরিস্থিতি বেশ ভালোই ছিল। অনেকের মতে, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য অভিযুক্ত অধ্যক্ষ নাকি অনেকাংশে দায়ী। ওঁর আমলে নাকি এমন বেশ কিছু বদল হয়, যা হাসপাতালটিকে কিছুটা খারাপ অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়। কয়েক বছর আগেও মেডিক্যাল কলেজের একটি র‌্যাঙ্কিংয়ে আরজি কর এক নম্বর ছিল। তাহলে আজ তার এমন অবস্থা কেন হল, সেটি ভেবে দেখার বিষয় আছে বৈকী।
  • Link to this news (হিন্দুস্তান টাইমস)