নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: বিনা কাজে সর্বত্র ঘুড়ে বেড়ায় এমন বাউন্ডুলে তিনি নন। কিন্তু আজ এই ফুটপাত তো কাল ওই ফুটপাতে রাত কাটে তাঁর। তবে তাঁকে ভবঘুরে মোটেও বলা যাবে না। তাঁর বিস্তর কাজ। কলকাতা শহরটাকে শুকনো খটখটে রাখতে চেষ্টার খামতি নেই। বর্ষার বৃষ্টিতে শহরের রাস্তায় যখন জল জমে, সবাই ছপছপ করে জল পেরিয়ে হাঁটাচলা করেন আর কর্পোরেশনকে শাপশাপান্ত করেন, তখন ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় নামেন ৫৫ বছরের প্রৌঢ় সুকুমার সর্দার। তখন তাঁর হাতে লাঠি। ভিজতে ভিজতে রাস্তার নর্দমার মুখ পরিষ্কার করেন। লাগাতার ভেজেন বলে কখনও জ্বরজারিও হয়। তখন বাড়ির কথা মনে পড়ে। ছেলেদের কথা পড়ে। তারপর কে জানে কোন ম্যাজিকে ওষুধ না খেয়েও জ্বর একদিন সেরে যায়। আবার বেরিয়ে পড়েন নর্দমা সাফ করতে।
তিনকূলে সবাই আছে সুকুমারের। তবু সবাই থেকেও কেউ নেই। বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ার মধ্য আটপুকুর গ্রামে। বলেন, ‘ছেলেরা আমাকে দেখে না। ঝগড়াঝাটি না করে একদিন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। আর ফিরে যাইনি। অচেনা এই শহরে চলে আসি। এখানেই থেকে গেলাম।’
বাড়িতে অভাব ছিল বলে জীবনে স্কুলের মুখ দেখেননি। কিন্তু পরিবেশ আর নাগরিক সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে টনটনে জ্ঞান। শহরে আসার পর দিনমজুরি জাতীয় কোনও কাজের খোঁজে ছিলেন। এক বৃষ্টির দুপুরে জোড়াবাগানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দেখেন বৃষ্টির জলে রাস্তার গালিপিট ভেসে যাচ্ছে। প্লাস্টিক আটকে জল থইথই করছে গোটা রাস্তা। ভেঙে পড়া একটি গাছের ডাল কুড়িয়ে বৃষ্টির মধ্যেই গালিপিটের মুখ থেকে সেই প্লাস্টিক সরাতে শুরু করেন। জল হুহু করে নেমে যায়। তারপর সে বৃষ্টি থামে। কিন্তু জল নামানোর নেশাটা সুকুমারের মাথা থেকে আর নামে না। পেটের ভাতের চিন্তা না করে ঘুরতে শুরু করেন শহরের অলিগলি-রাজপথ। জল দূর করে, নর্দমা থেকে প্লাস্টিক সরিয়ে তবে শান্তি। এভাবে কাজ বেড়েই চলেছে। দিনের বেলা মোটেও সময় পান না। রাতে বৃষ্টি হলেও নেমে পড়েন স্বেচ্ছাকর্মে। ফলে কোনওদিন আধপেটা। কোনওদিন খাওয়াই জোটে না। তবে জলকাদামুক্ত একটি শহর মানুষকে উপহার দেওয়ার অভিপ্রায়ে নর্দমা খুঁচিয়েই চলেন সুকুমার। তাঁর ক্লান্তি নেই, বিরক্তি নেই, ঘুম নেই, খাওয়া নেই। ‘এমন পাগল মানুষের দেখা আজকাল কি মেলে?’ কতজন প্রশ্ন করেন। কতজন আবার দু-দশ টাকা হাতে গুঁজে দেন। কেউ আবার ভাতের হোটেলে নিয়ে গিয়ে পেট ভরে মাছ-ভাত খাওয়ান। এভাবে দিব্যি দিন চলে যাচ্ছে সুকুমারবাবু।
দুঃখ-বিরক্তি নেই, তবে অভিমান আছে শহরের নাগরিকদের নিয়ে। বলেন, ‘সবাই একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে চলে যাচ্ছেন। কেউ ডাস্টবিনে আবর্জনা ফেলছেন না।’ যদি তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, ‘শহরের মানুষ আপনাকে সম্মান করে সুকুমারবাবু।’ তখন উত্তেজিত হয়ে পড়েন। বলেন, ‘কেন, আমি এমন কী কাজ করেছি যে আমাকে সম্মান দেবে? এসবের ধার ধারি না। আমি গরীব। পথেঘাটে জীবন কাটে। ভালোবেসেই কাজ করি। কিছু মানুষ ভালোবাসেন। টাকাপয়সাও দেন। দিব্যি খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি।’ ক্যারিব্যাগ বইবার জন্য একটি বস্তা জোগাড় করেছেন। তাতে ভরে কোনও ভ্যাটে ক্যারিব্যাগ ফেলে আসেন। আবার নর্দমা সাফাই দিনভর।
সন্ধ্যায় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে। প্রবল বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সুকুমার চলেছেন, হাতে লাঠি। কাঁধে বস্তা। যেতে যেতে বলছেন, ‘জলের উপর দিয়ে যাবেন না। ফুটপাত দিয়ে যান। বাজ পড়ছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি যান মা-বাবারা…’ অদৃশ্য হয়ে গেলেন ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির গলিতে।
একটা বাঁশিওয়ালা পেয়েছিল হ্যামলিন। কলকাতাও কম যায় না। তার একজন বস্তা কাঁধে-লাঠি হাতে, সুকুমার আছে। যে কোনওদিন বাঁশিওয়ালার মতো শহর ছেড়ে যাবে না। সুকুমারবাবু এ শহরের একজন স্ট্রিট ফাইটার। একজন একজন হিরো।