এই সময়, ঝাড়গ্রাম: জ্বলন্ত শলাকায় বিদ্ধ করে হাতি-হত্যার বিচার চেয়ে প্রতিবাদ মিছিলের ডাক দিয়েছিল ‘কুড়মি সমাজ পশ্চিমবঙ্গ’। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, পতাকা এবং রং ভুলে রাস্তায় প্রতিবাদ মিছিলে পা মেলালেন লাল-গেরুয়া-হলুদ-সবুজ সব শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা! রবিবার বিকেলে এমন ব্যতিক্রমী ঘটনার সাক্ষী থাকল ঝাড়গ্রাম শহর।পাশাপাশি, এ দিন ময়নাতদন্তের রিপোর্টে জানা গিয়েছে, নিহত হাতিটি অন্তঃসত্ত্বা ছিল। এমনকী, হাতিটি প্রেগন্যান্সির অ্যাডভান্সড স্টেজেও ছিল। ঝাড়গ্রামের ডিএফও উমর ইমাম ময়নাতদন্তের রিপোর্ট নিয়ে মুখ খোলেননি। তিনি শুধু বলেছেন, ‘ঘটনায় এখনও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।’ তবে এ দিন প্রেগন্যান্সির বিষয়টি সামনে আসায় সোশ্যাল মিডিয়াতেও ক্ষোভ আছড়ে পড়ে। তীব্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন সেলিব্রিটিরাও।
ঝাড়গ্রামে হাতি-হত্যার ঘটনাটির সঙ্গে কেরালায় বোমা ভরা আনারস খাইয়ে হাতি হত্যার তুলনা করা হচ্ছে। কার্টুনিস্ট নচিকেতা মাহাতো সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি কার্টুন পোস্ট করেছেন। সেখানে মা হাতি শাবককে সান্ত্বনা দিয়ে বলছে, ‘চিন্তা করিস না বাছা, প্রকৃতি ওদের বিচার করবে।’
আবার হাতির ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে, ‘এই পৃথিবীতে আমার বাঁচার অধিকার ততটাই, যতটা মানুষের।’ হাতির মৃত্যুর পর শাবক কান্নাচোখে ডাকছে, ‘মা ওঠো না, খেলতে যাবে না?’ আরেক জায়গায় অন্তঃসত্ত্বা হাতির পিঠে জ্বলন্ত শলাকা বিদ্ধ অবস্থায় হাতি প্রশ্ন তুলেছে, ‘মানুষ তো সভ্য, আমরাই বন্য…তাই না বলুন?’
অন্তঃসত্ত্বা হাতি মৃত্যুর ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে ইতিমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘নৃশংসতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে! ঝাড়গ্রামে প্রেগন্যান্ট হাতিটিকে খুন করা হলো।’ নিজের এক্স হ্যান্ডলে মিমি চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘এর দায় কে নেবে? আমরা মানুষ হিসেবে এবং সমাজ হিসেবে ব্যর্থ। আর কত?’ ফেসবুকের প্রোফাইল পাল্টে ফেলেছেন পরিচালক তথাগত মুখোপাধ্যায়। হাতি হত্যা নিয়ে সরব হয়েছেন তিনি। অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্র লিখেছেন, ‘আমরা বোধহয় সত্যি ধ্বংসের পথে এগোচ্ছি। আর এ সব দেখতে পারি না।’
সে দিনের হাড়হিম করা ভিডিয়ো দেখে এক শিশুকন্যার কান্না এবং তাঁর বাবাকে করা নানা প্রশ্নও ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। অভিনেত্রী বিনীতা গুহ লিখেছেন, ‘হাতিটা আগুনে পুড়ে যন্ত্রণা পেতে পেতে মৃত্যুবরণ করেছে! বুঝতে পারছেন যন্ত্রণাটা! সঙ্গে একটি শিশু হাতি ছিল, সে আগুন দেখে হাতিটির ছটফটানি আর চিৎকার শুনে লুকিয়ে যায় ভয়ে! নির্ঘুম রাত দিন কাটছে। কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না, মা হাতিটার ওই আর্তনাদ! কানে বাজছে! চোখের সামনে ভাসছে!’
অভিনেতা-নির্দেশক দেবদূত ঘোষ লিখেছেন, ‘মানুষ কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, তার প্রমাণ দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত। এই সভ্যতার শেষ মানুষের হাতে ঘটবে। পুলিশ, বন দপ্তর কী ব্যবস্থা নিয়েছে?’ আরও এক অভিনেতা তথা সমাজকর্মী চিরঞ্জীব গোস্বামী বলেন, ‘হাতির পিঠে জ্বলন্ত শলাকার ভিডিয়ো দেখে কার্যত অবাক হয়েছি! মা হাতিটির মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তার শাবকের কথাই দিনরাত শুধু মনে পড়ছে।’
ঝাড়গ্রামে হাতি হত্যার ঘটনায় কুড়মিদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, কুড়মিরা প্রকৃতির সন্তান। ‘হাতি ঠাকুর’কে তাঁরা পুজো করেন। তাই এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করে পথে নামার ডাক দিয়েছিলেন তাঁরা। রবিবার বিকেলে শহরের কেন্দ্রীয় বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে মিছিল শুরু হলে দেখা যায়, তাতে রাজনৈতিক পরিচয় ভুলে সব দলের কর্মী-সমর্থকেরাই যোগ দিয়েছেন।
বনমন্ত্রী ও ডিএফওর পদত্যাগের পাশাপাশি বন্যপ্রাণ সুরক্ষা আইন অনুযায়ী তাঁদের দু’জনকে গ্রেপ্তারের দাবিও তোলা হয় মিছিল থেকে। শহর পরিক্রমা করে মিছিলটি ফের বাসস্ট্যান্ডে এসে শেষ হয়। এ দিনের মিছিলে পা মেলানো বাম নেতা প্রতীক মৈত্র বলেন, ‘যে ভাবে হাতিটির মৃত্যু হয়েছে, তা মেনে নেওয়া যায় না।’
পরিবেশ কর্মী রাকেশ মুদলি বলেন, ‘ঝাড়খণ্ডের দলমা এবং ওডিশার ময়ূরভঞ্জে যে ভাবে পাহাড়-জঙ্গল কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে, তাতে হাতিরা নিজেদের জায়গা ছেড়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। যার ফলেই এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রায়শই এখন ঘটে চলেছে। এ বিষয়ে তিনটি রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে সমাধানের পথ খুঁজে বের করা দরকার।’
এ দিনের মিছিলের আহ্বায়ক তথা কুড়মি সমাজ পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সভাপতি রাজেশ মাহাতো বলেন, ‘প্রতিবাদী মানুষের কোনও জাত-ধর্ম-বর্ণ-দল হয় না। নিরীহ বন্যপ্রাণীর হত্যায় জঙ্গলমহলের প্রত্যেকটি মানুষের মনে বেদনা জাগ্রত হয়েছে। তারই ফলে এ দিন সকলে যোগদান করেছেন মিছিলে। আমরা আহ্বায়ক হিসেবে নামমাত্র থাকলেও সকল প্রতিবাদী মানুষ এক জায়গায় এসেছেন। কৃতজ্ঞতা জানাই।’