ভাগ্যের ফেরে বৃদ্ধ দিলীপকুমার দাসের ঠাঁই হল রানাঘাটের ভবঘুরে আবাসে
বর্তমান | ২০ আগস্ট ২০২৪
দীপন ঘোষাল, রানাঘাট: বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। বয়সের ভারে সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়েছে ছিপছিপে শরীরটা। এক মনে শুকনো গাছের পাতাগুলি তুলতে তুলতে গুনগুন করছেন। মাঝে মধ্যে পাতা তোলা ছেড়ে হাত দুটো নেচে উঠছে শূন্যে। যেন তাঁর এক হাতে রয়েছে তবলা আর অন্যটায় বাঁয়া। ‘ভদ্রলোক কি তবলা বাজাতে পারেন’? কৌতুহলী প্রশ্ন শুনে প্রথমে একগাল হাসি রানাঘাট ‘নীড়াশ্রয়’-এর কর্মীর। জবাব দিলেন, ভদ্রলোক পণ্ডিত রাধাকান্ত নন্দীর শিষ্য ছিলেন এককালে। ভাগ্য তাঁকে টেনে এনেছে গৃহহীনদের ছাউনিতে।
শহরের গৃহহীন মানুষদের থাকার জন্য রাজ্য সরকার বিভিন্ন জায়গায় তৈরি করেছে ‘শেল্টার ফর আরবান হোমলেস’। কিছুটা আশ্রম গোছের এই ব্যবস্থায় গৃহহীন মানুষজনের বসবাসের ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে প্রশাসন। রানাঘাট শহরের বুকেও বছরখানেক আগে এরকমই শেল্টার তৈরি করা হয়। যার পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছে ‘নীড়াশ্রয়’। চূর্ণী নদীর পাড়ে তিনতলা বিরাট ভবনে বসবাস করেন বহু গৃহহীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। কিছুটা রাজ্য সরকারের খরচ আর বাকিটা রানাঘাট পুরসভার অর্থে চলে আবাসটি। সেখানকারই বর্তমান বাসিন্দা প্রায় বছর সত্তরের দিলীপকুমার দাস। পরিচয়ের খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, প্রখ্যাত তবলাবাদক পণ্ডিত রাধাকান্ত নন্দীর শিষ্য ছিলেন তিনি। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে তো বটেই, ভিন রাজ্যেও তবলা বাদক হিসেবে চুটিয়ে অনুষ্ঠান করেছেন। একসময় বেশ নামডাকও হয়। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে একদিন কার্যত লন্ডভন্ড হয়ে যায় তাঁর জীবন। পারিবারিক কারণে ঘরছাড়া হতে হয়। তবলাই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। তাই স্থায়ী চাকরি কোনওদিন করেননি। অর্থাভাবে হাতছাড়া হয় পছন্দের তিনটি তবলার সেট। জীবনের কঠিন পরিস্থিতি তাঁকে এনে দাঁড় করায় রেল স্টেশনে। পলতা স্টেশনে বাকি ভবঘুরেদের সঙ্গেই বছরের পর বছর কাটিয়েছেন। দু’মুঠো ভাতের জন্য আসতেন রানাঘাট স্টেশনে। শিয়ালদহ ডিভিশনের বিভিন্ন স্টেশনে ঘুরে চেয়ে চিনতে পেটের সংস্থান করতে হতো। অবশেষে নীড়াশ্রয়ে তাঁকে আনা হয় এখানে। তাতে ভেঙে যাওয়া শরীর কিছুটা ফিরেছে। জীবনে এসেছে স্থিরতা। কেবল প্রাণের তবলাগুলোই আজ তাঁর কাছে নেই।
তবে একবার সুযোগ হয়েছিল বাকি আবাসিক এবং নীড়াশ্রয়ের কর্মীদের সামনে তাঁর দক্ষতা মেলে ধরার। এই বয়সেও তাঁর হাতের তাল শুনে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন সবাই। ভাগ্যের ফেরে হয়তো সাধারণ মানুষের স্মৃতিতে হয়তো জায়গা করে নিতে পারেননি, কিন্তু তবলা বাজানোর পর নীড়াশ্রয়ের সকলের চোখে সেলিব্রিটি। মাঝেমধ্যেই ভিড় জমে তবলা অথবা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন ব্যাকরণ শোনার লোভে।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দিলীপবাবু বলেন, শ্যামবাজারে গুরুজি তবলা শেখাতেন। ওখানেই আমার শিক্ষার শুরু। প্রায় দু’বছর সেই ক্লাসে শেখার পর সরাসরি গুরুজির বাড়িতে যেতাম তালিম নিতে। সেখানেও প্রায় বছর দুয়েক গিয়েছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিবারিক সমস্যার জন্য তবলা শেখা ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করছি। সেই পারিশ্রমিকেই আমার এবং স্ত্রীর চলে যেত। পরে বাড়িছাড়া হতে হয়েছে। বহুদিন স্টেশনে রাত কাটিয়েছি। সেই সময় হাতের কাছে তবলা ছিল না। আজ খুব ইচ্ছা করে সেই বয়সে ফিরে যেতে।
কথাগুলো বলতে বলতে চোখের কোণ ভিজে আসছিল দিলীপবাবুর। নিজেকে সামলে বলেন, এখনও বাজাতে চাই। আমার বাকি জীবনটা আমার সঙ্গী হতে পারত বাজনাটা। কেবল এক সেট তবলা যদি থাকত।