এই সময়: প্রথমে মুখ্যমন্ত্রী, তার পর মেডিক্যাল কাউন্সিল, মাঝে কলকাতা হাইকোর্টের পরে মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টও সমাজের স্বার্থে জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার করার আবেদন জানিয়েছে। কিন্তু ১১ দিন পরেও আন্দোলনকারীরা এখনও তাঁদের ধর্মঘটে অনড়। জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি, আরজি করে তরুণী চিকিৎসকের খুন-ধর্ষণের নেপথ্যে থাকা অপরাধীদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি সিবিআই তদন্তের সন্তোষজনক অগ্রগতি না জানতে পারা পর্যন্ত তাঁরা কর্মবিরতি চালিয়ে যাবেন।আরজি করে মর্মান্তিক ঘটনার প্রেক্ষিতে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনকে দলমত নির্বিশেষে সমর্থন করেছেন আমজনতা। কিন্তু সেই সাধারণ মানুষই এখন টানা কর্মবিরতির জেরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। চিকিৎসা মিলবে না, এই আশঙ্কায় রোগীকুলের একটা বড় অংশই তাই এখন আর যাচ্ছেন না সরকারি মেডিক্যাল কলেজের চত্বরে। হয় রোগ চেপে বসে থাকছেন বাড়িতেই, নইলে পকেট শূন্য করে চিকিৎসা করাতে বাধ্য হচ্ছেন বেসরকারি হাসপাতালে।
ফলে সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে রোগীর সংখ্যা কমে গিয়েছে কোথাও ৫০ শতাংশ, তো কোথাও আবার ৯০ শতাংশ। আর যাঁরা আসছেন হাসপাতালে, তাঁরাও যে যথাযথ পরিষেবা পাচ্ছেন, এমনটা নয়। যেমন প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের সমস্যায় জেরবার গড়িয়ার ষাটোর্ধ্ব প্রমথেশ হালদার। ওষুধপত্রে কাজ না হওয়ায় দু' সপ্তাহ আগে এদিন তাঁকে অপারেশনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেছিলেন এসএসকেএমের ইউরোলজি বিভাগের চিকিৎসক।
কিন্তু এদিন ভর্তির জন্য এসে তাঁকে শুনতে হয়- পরের মঙ্গলবার আসুন। এনআরএসের অর্থোপেডিক বিভাগের চিকিৎসকের পরামর্শমতো ভাঙা পায়ের অপারেশন করার জন্য ভর্তি হতে এসে একই অভিজ্ঞতা হয়েছে রাজাবাজারের মাঝবয়সি রেজনা বিবির। আরজি করে ডায়ালিসিস করতে আসা বাগুইআটির রমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মঙ্গলবার নিয়ে পর পর তিন দিন ফিরে যেতে হয়েছে বিনা চিকিৎসায়।
আমজনতার একটা বড় অংশও বুঝে গিয়েছেন, সরকারি হাসপাতালে গেলেও চিকিৎসা মেলার সম্ভাবনা কম। তাই রোগীও আসছে না হাসপাতালে। আরজি করে সোমবার ২০০০ শয্যায় ভর্তি রয়েছেন মাত্র ১২৬ জন রোগী। ওই দিন সেখানে আউটডোরে এসেছিলেন মাত্র ৩৬৪ জন। স্বাভাবিক সময়ে সংখ্যাটা থাকে সাধারণত হাজার ছয়েক।
এসএসকেএমে প্রতি সোমবার যেখানে অন্তত ৯০০০ রোগী আউটডোরে আসেন, সেখানে গত সোমবার এসেছিলেন ৩৬০০ জন। এনআরএসের আউটডোরে হাজার সাতেকের বদলে ওই দিন হাজির ছিলেন ২২০০ রোগী। প্রতি সোমবার কলকাতা মেডিক্যালে যেখানে অন্তত ৫০০০ রোগী আসেন আউটডোরে, সেখানে গত সোমবার এসেছিলেন মাত্র ১৯০০ জন।
স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রে খবর, কমবেশি সব সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছবিটা প্রায় একই রকম। তবে সঙ্কটের বহর স্বাভাবিক কারণেই কিছুটা বেশি আন্দোলনের ভরকেন্দ্র আরজি কর হাসপাতালে। ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছেন রাজ্যবাসী, সেই আন্দোলনের অনত্যম অঙ্গ যে কর্মবিরতি, তার কোপেই পড়েছে গরিব-নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের স্বাস্থ্য।
বস্তুত, গত ১১ দিনে বহু রোগী হাসপাতালে গিয়ে হয়রান হওয়ার পরেও বলেছেন, জুনিয়র ডাক্তাররা ঠিক করছেন। তবে যত দিন গড়িয়েছে, সেই সমর্থন অনেকের ক্ষেত্রেই ধীরে ধীরে হতাশা, কারও কারও বা ক্ষোভে বদলে গিয়েছে। এনআরএসে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত ছেলেকে নিয়ে আসা এন্টালির মহম্মদ শামসউদ্দিন বলছিলেন, 'আমাদের তো প্রাইভেটে যাওয়ার ক্ষমতা নেই। আর কোথায় গেলে ছেলেটা চিকিৎসা পাবে, জানি না!'
এমন ছবি অবশ্য শুধু কলকাতা কিংবা বাংলার নয়, কমবেশি সারা দেশেই। আরজি করের ঘটনায় গড়ে ওঠা আন্দোলনকে সহমর্মিতা জানাতে কর্মবিরতিতে সামিল হয়েছেন সারা দেশের জুনিয়র ডাক্তাররাই। ফলে রোগী পরিষেবায় প্রভাব পড়ছে সর্বত্র। তাই এদিন সুপ্রিম কোর্টে শুনানি চলাকালীন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় বলেন, 'ধর্মঘটী চিকিত্সকদের অবিলম্বে কাজে ফেরার জন্য অনুরোধ করছি। সমাজের স্বার্থেই তাঁরা কাজে ফিরুন। তাঁদের উদ্বেগের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে দেশের সুপ্রিম কোর্ট। আদালতের উপর আস্থা রাখুন।'
কিন্তু শীর্ষ আদালতের অন্তর্বর্তী নির্দেশে খুব একটা খুশি হতে পারেননি আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা। আরজি করে সব মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধিদের জিবি মিটিংয়ের পর তাঁরা জানান, এখনই কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা হচ্ছে না। আন্দোলনকারীরা জানাচ্ছেন, আগামী কাল, বৃহস্পতিবার সু্প্রিম কোর্টে সিবিআই তদন্তের স্টেটাস রিপোর্ট জমা পড়ার পরে যদি দেখা যায় তা সন্তোষজনক, তখন কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা হতে পারে।
সারা দেশেও বিভিন্ন সংগঠন সুপ্রিম কোর্টের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করছে। কোথাও কোথাও এদিনই প্রত্যাহারের বার্তা দেওয়া হয়েছে। আরজি করের অ্যানাস্থেশিয়ার জুনিয়র রেসিডেন্ট ডাক্তার অনিকেত মাহাতো এপ্রসঙ্গে বলেন, 'আমাদের আন্দোলনের মূল দাবি হলো চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের মূল অপরাধীদের চিহ্নিতকরণ ও গ্রেপ্তারি। কিন্তু সিবিআই তদন্তের গতি-প্রকৃতি কী, তার কিছুই জানতে পারিনি। তাই আপাতত কর্মবিরতি চলবে।'