• মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি উস্কে দিচ্ছে রানাঘাটে থমকে যাওয়া বাংলাদেশের মালগাড়ি
    বর্তমান | ২১ আগস্ট ২০২৪
  • দীপন ঘোষাল, রানাঘাট: লাল রঙের প্রায় খান তিরিশেক রেক। সবকটিই মালগড়ির। তার গায়েই বড়বড় করে লেখা ‘বিআর’। অর্থাৎ বাংলাদেশ রেলওয়ে। আগস্টের শুরুতেই নবনির্মিত কোচগুলি বাংলাদেশ রেলওয়ের হাতে হস্তান্তর করার কথা ছিল ভারতের। কিন্তু বাংলাদেশের অস্থির পরিস্থিতির কারণে বন্ধ দুই দেশের রেল যোগাযোগ। পরবর্তীতে দু’দেশের কূটনৈতিক অবস্থান কোন দিকে গড়াবে তা এখনও নিশ্চিত নয়। এহেন ডামাডোলে মালগাড়িটির চাকা অনির্দিষ্টকালের জন্য থমকে গিয়েছে। অগত্যা, যার বর্তমান ঠিকানা রানাঘাট স্টেশনের ৩নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাশে একটি লুপ লাইন। রোদ, ঝড়-জলের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা সারবদ্ধ মালগাড়ির বগিগুলি যেন ইতিহাসকে নাড়া দিচ্ছে। মনে করাচ্ছে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ভারত ভূখণ্ডে আটকে পড়া ‘ইস্ট পাকিস্তান রেলওয়ে’র সেই ঐতিহাসিক ইঞ্জিনটির কথা।

    তখন টালমাটাল পরিস্থিতি। স্বাধীনতার দাবিতে গর্জে উঠছে পূর্ব পাকিস্তানের শহর থেকে গ্রাম। পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তির দাবিতে সরাসরি লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছেন ধূতি-পাঞ্জাবি পরা অসংখ্য বাঙালি। যাঁরা পরবর্তীকালে ভূষিত হয়েছেন ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে। সেই লড়াইয়ে তাঁদের সহযোগী ছিল ভারত। স্বাধীনতার আন্দোলন চলাকালীন বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার সেনাবল, অস্ত্র, গেরিলা আক্রমণের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে আন্দোলনকারীদের। এহেন টালমাটাল পরিস্থিতিতে, ১৯৭১ সালে ভারত-পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় রেল যোগাযোগ। ভারত ভূখণ্ডে এসে আর ফিরতে পারেনি ‘পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে’র একটি বাষ্পচালিত ইঞ্জিন। ঠাঁই হয়, ব্যান্ডেল ইয়ার্ডে। যা আজও ঐতিহাসিক নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাওড়া স্টেশন সংলগ্ন রেল মিউজিয়ামে। ইতিহাসের এই ঘটনাকেই যেন ফের নাড়া দিচ্ছে রানাঘাট স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য তৈরি হওয়া নতুন মালগাড়ির রেকগুলি। প্রথমে কোটাবিরোধী আন্দোলন। তারপর সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদচ্যুত করার দাবিতে সরকার বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়লেও এখনও স্বাভাবিক ছন্দে ফেরেনি প্রতিবেশী দেশ। অশান্তির কারণে ৭১সালের মতোই ভারত-বাংলাদেশ রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। তাই বাংলাদেশ রেলওয়ের তরফে ভারতের কাছে বরাত দেওয়া মালগাড়ির বগিগুলি তৈরি হয়ে গেলেও তার ‘ডেলিভারি’ হয়নি। পূর্ব রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, আগস্টের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই রেকগুলি নেওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশ রেলের। কিন্তু সেইসময় ঢাকার রাজপথে ছাত্র আন্দোলন চলে। ফলে রানাঘাট পর্যন্ত এসেই দাঁড় করিয়ে দিতে হয় রেকগুলি। পরে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনির্দিষ্টকালের জন্য থমকে যায় চাকা। ভবিষ্যতে দু’দেশের  সম্পর্ক কেমন হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে কি সেই ৭১-এর আটকে পড়া ইঞ্জিনটির মতোই অবস্থা হবে রেকগুলির?

    পূর্বরেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক কৌশিক মিত্র বলেন, যেহেতু দুই দেশের মধ্যে রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে তাই রেকটি আটকে রয়েছে রানাঘাট স্টেশনে। দু’দেশের মধ্যে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হলে আমরা সেগুলি পাঠাতে পারব। ভারতকে বরাত দেওয়া হয়েছিল। তাই প্রস্তুত করে পাঠানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। আমরা বাংলাদেশ রেলওয়ের তরফে সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় রয়েছি।

    প্রসঙ্গত, দীর্ঘদিন ধরে রেকটি দাঁড়িয়ে থাকার কারণে একটি লুপ লাইন কার্যত ‘ব্লক’ হয়ে রয়েছে। যদিও রেলের দাবি, এজন্য বিশেষ সমস্যা হচ্ছে না। সাধারণত ওই লাইন ব্যবহার না হওয়ায় সেখানে রাখা হয়েছে।
  • Link to this news (বর্তমান)