এই সময়: তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের ঘটনার পর থেকে আরজি কর হাসপাতালে আর্থিক দুর্নীতির পুরোনো একগুচ্ছ অভিযোগ নতুন করে মাথাচাড়া দিচ্ছিল। এই আর্থিক দুর্নীতির তদন্তে ইতিমধ্যে একটি বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করেছে রাজ্য। টালা থানায় দায়ের হওয়া একটি অভিযোগের ভিত্তিতে মামলাও দায়ের হয়েছে, যেখানে তদন্তকারীদের নজরে রয়েছেন আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ।এ বার এই আর্থিক দুর্নীতি-সহ আরজি করে বেশ কিছু কেলেঙ্কারির অভিযোগ তুলে ইডি তদন্তের দাবিতে নতুন মামলা দায়ের হলো কলকাতা হাইকোর্টে। তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুন মামলার তদন্তে ছ’দিন ধরে সন্দীপকে বারবার তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছে সিবিআই। তার মধ্যে এ দিন আর্থিক দুর্নীতির ঘটনায় আর এক কেন্দ্রীয় এজেন্সি ইডি-র চেয়ে মামলা হওয়ায় আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে চাপ আরও বাড়তে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
আদালতে নালিশ পুলিশের বিরুদ্ধে
সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে এক বছর আগেই স্টেট ভিজিল্যান্স কমিশনে চিঠি দিয়েছিলেন আরজি করের প্রাক্তন ডেপুটি সুপার আখতার আলি। অভিযোগ দায়ের করেছিলেন পুলিশেও। তবে সেই অভিযোগের পরে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে গত ক’দিন ধরেই দাবি করছিলেন। বুধবার আখতার আলিই ইডি তদন্তে চেয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন।
বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজের এজলাসে তাঁর আইনজীবী তরুণজ্যোতি তিওয়ারির অভিযোগ, ‘একবছর আগে টালা থানায় অভিযোগ জানালেও এত দিন পুলিশ কিছু করেনি। এখন ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেওয়ায় তড়িঘড়ি কলকাতা পুলিশ এফআইআর করে তদন্ত শুরু করেছে।’
তথ্যপ্রমাণ লোপাটের জন্যই এই প্রহসন বলে অভিযোগ করেন আইনজীবী। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রাক্তন ডেপুটি সুপার আখতার আলি নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন বলেও তাঁর আইনজীবী আদালতে জানান। জানানো হয় নিরাপত্তার আর্জি। মামলা দায়ের করার অনুমতি দিয়েছে আদালত। আজ, বৃহস্পতিবার শুনানি হতে পারে।
নিরাপত্তা চায় সন্দীপের পরিবারও
তাঁর বিরুদ্ধে যে ভাবে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে আন্দোলন চলছে, তার প্রেক্ষিতে নিরাপত্তা চেয়ে কলকাতা হাইকোর্টে আগেই মামলা করেছিলেন সন্দীপ ঘোষ। পাশাপাশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে যে ধরনের খবর পরিবেশিত হচ্ছে, তার ভিত্তিতে মিডিয়া ট্রায়াল বন্ধ করার জন্যও এ দিন আর্জি জানান তিনি। যদিও বৃহস্পতিবার শুনানি শেষে বিচারপতি শম্পা সরকারের বক্তব্য, মামলাকারীর পক্ষে ব্ল্যাঙ্কেট অর্ডার দেওয়া সম্ভব নয়। তবে মিডিয়াকে শালীনতা রেখে খবর করতে হবে বলেও জানায় আদালত।
বিচারপতি আরও জানান, যে সাংবাদিক খবর করছেন, তিনি কোনও সোর্সের ভিত্তিতে খবর করলে তার দায়িত্ব তাঁকেই নিতে হবে। আবার সন্দীপ ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা চেয়ে পৃথক মামলা করেছিলেন তাঁর শ্বশুরমশাই। তাঁর আইনজীবী আদালতে জানান, বাড়িতে সন্দীপ, তাঁর স্ত্রী, দুই সন্তান, শাশুড়ি-সহ অন্যরা থাকেন। বর্তমান আবহে তাঁরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন।
সরকারি কৌঁসুলি বিচারপতি ভরদ্বাজের এজলাসে জানান, সন্দীপের বাড়ির সামনে ২৪ ঘণ্টা পুলিশ পিকেট রয়েছে। মোবাইল ভ্যানও মোতায়েন থাকছে। ওসি বেলেঘাটা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করেছেন। আদালত নির্দেশ দিয়েছে, সন্দীপ ঘোষের পরিবারের নিরাপত্তায় যেন কোনও ফাঁক না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে বেলেঘাটা থানার ওসিকে।
সিবিআই নজরে সন্দীপের গাড়ি
গত শুক্রবার থেকে সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে টানা ডেকে সন্দীপকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে সিবিআই। বুধবারও রাত পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষকে। সিবিআই সূত্রের খবর, তরুণী চিকিৎসকের মৃত্যুর খবর জানার পরে কে বা কারা হাসপাতাল থেকে তাঁর বাড়িতে ফোন করেছিলেন, আরজি করের সেমিনার রুমের অকুস্থল কোনও ভাবে নষ্ট করা হয়েছে কি না, তরুণী চিকিৎসককে কখনও কোনও হুমকির মুখে পড়তে হয়েছিল কি না এবং তাঁর ধর্ষণ-খুনের খবর পাওয়ার পরে অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি কী ব্যবস্থা নিয়েছিলেন— এই সব তথ্যই বারবার সন্দীপের কাছে জানতে চাওয়া হচ্ছে।
সূত্রের খবর, জিজ্ঞাসাবাদে সন্দীপ দাবি করেছেন, কোনও অন্যায়ের সঙ্গে তিনি যুক্ত নন। কোনও প্রমাণ লোপাট করা হয়নি। আরজি করের অধ্যক্ষ থাকাকালীন যে গাড়িটি ব্যবহার করতেন সন্দীপ, সেটিও এ দিন সিজিও কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। গাড়িটি পরীক্ষা করে দেখেন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা। চালককেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ধর্ষণ-খুনের ঘটনার পরে গাড়িটি কোথায় কোথায় নিয়ে গিয়েছিলেন সন্দীপ, সেখানে আরও কেউ উঠেছিলেন কি না— সে বিষয়ে নিশ্চিত হতেই গাড়ি পরীক্ষা বলে সূত্রের দাবি।
আরজি করে ধর্ষণ-খুনের ঘটনার পরে নির্যাতিতার নাম-পরিচয় তিনি প্রকাশ্যে এনেছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। এই মামলায় তাঁকে বৃহস্পতিবার হাজিরা দেওয়ার জন্য নোটিস পাঠিয়েছিল কলকাতা পুলিশ। তবে সিবিআই অফিসে হাজিরার কারণে তিনি লালবাজারে আসতে পারেননি। কলকাতা পুলিশের তদন্তকারীদের কাছ থেকে কিছু সময় চেয়েছেন তিনি।