এই সময়: জমে উঠছে ‘কোল্ড’ অপারেশন। আগে থেকে পরিকল্পনা বা প্ল্যান করা অপারেশনের এটাই চলতি নাম। আরজি কর হাসপাতালের ঘটনার পর কার্যত ৯ অগস্ট থেকেই স্নাতকোত্তর পড়ুয়া বা পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি (পিজিটি)-র মতো জুনিয়র ডাক্তাররা কর্মবিরতিতে।সরকারি হাসপাতালের এক প্রশাসকের কথায়, ‘প্রতিটি অপারেশনের জন্য সবচেয়ে জরুরি অ্যানাস্থেশিয়া। মূলত এই পিজিটি এবং পিডিটি (পোস্ট ডক্টরাল ট্রেনি)-রাই সরকারি হাসপাতালে অ্যানাস্থেটিস্ট-এর কাজ করেন। তাঁরাই কাজ না-করায় জমছে কোল্ড অপারেশন।’ সিনিয়র ডাক্তারদের দিয়ে কোনও মতে এমারজেন্সি অপারেশনগুলো করা হচ্ছে। তবে, ইন্ডোর, আউটডোরে রোগী দেখার পরে ওটি সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন সিনিয়র ডাক্তাররা।
শহরের মেডিক্যাল কলেজগুলি সূত্রে খবর, এক-একটি হাসপাতালে গড়ে রোজ বাতিল হচ্ছে ৬০-১০০টি করে কোল্ড অপারেশন। গত ১২ দিনের কর্মবিরতিতে কলকাতা ও লাগোয়া শহরতলির ৬টি মেডিক্যাল কলেজ মিলিয়ে প্রায় হাজার সাতেক অপারেশন বাতিল হয়েছে। চিন্তার হলো, এর মধ্যে প্রায় প্রচুর ক্যান্সার সার্জারির কেস রয়েছে। চিকিৎসকদের আশঙ্কা, এই অপারেশনে দেরি প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।
এসএসকেএমের এক কর্তা জানাচ্ছেন, তাঁদের হাসপাতালেই গড়ে রোজ ১২০টি অপারেশন হয়। কিন্তু পিজিটি-দের অভাবে ৫০-৬০টির বেশি অস্ত্রোপচার হচ্ছেই না এখন। ফলে রোজ জমে যাচ্ছে ব্যাক-লগ। সেই ব্যাক-লগের পাহাড় এখনই প্রায় ৬০০ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানকার এক প্রশাসনিক আধিকারিক জানাচ্ছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এখন যাঁদের অপারেশন স্থগিত হচ্ছে, তাঁদেরই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
এসএসকেএমের জেনারেল সার্জারি বিভাগে সবচেয়ে বেশি, দৈনিক প্রায় ৮-১০টি অপারেশন হয়। কিন্তু এখন সেখানে বড়জোর ৩-৪টি করে প্ল্যানড সার্জারি হচ্ছে। এসএসকেএমের জেনারেল সার্জারির শিক্ষক-চিকিৎসক তথা ব্রেস্ট ক্লিনিকের প্রধান দীপ্তেন্দ্র সরকার বলছেন, ‘হার্নিয়া, গলব্লাডার, অ্যাপেনডিক্স বা অন্যান্য পরিকল্পিত অস্ত্রোপচার পিছিয়ে গেলে খুব বেশি সমস্যা নেই। কিন্তু ক্যান্সার সার্জারি পিছিয়ে গেলে মুশকিল। তাই সব অপারেশনের মধ্যে ক্যান্সার সার্জারি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করছি। বুধবারই তিনটে করেছি।’
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে খবর, সেখানে দৈনিক প্রায় ১০০টি সার্জারি হয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে অপারেশন হচ্ছে বড়জোর ২৫-৩০টি। এর মধ্যে ক্যান্সার রোগীও রয়েছেন। পিজিটি-দের অনুপস্থিতিতে সিনিয়র ডাক্তাররা দিনরাত পরিশ্রম করেও পরিস্থিতি সামলাতে পারছেন না। হাসপাতালে সাধারণত জেনারেল সার্জারি, কার্ডিয়োথোরাসিক ভাস্কুলার সার্জারি, আই, ইএনটি, প্লাস্টিক সার্জারি, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ, ইউরোলজি, অর্থোপেডিকস, পেডিয়াট্রিক বিভাগে নিয়মিত প্রচুর অপারেশন হয়।
এনআরএসের এক প্রশাসনিক কর্তার কথায়, ‘প্রতিটি অপারেশনের জন্যই অপরিহার্য হলো একটি বিভাগ— অ্যানাস্থেশিয়া। ওই বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা উদয়াস্ত খেটেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছেন না। বিভাগের পিজিটি-রা কর্মবিরতিতে। অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, প্রফেসর, এমনকী বিভাগীয় প্রধান পর্যন্ত দিনরাত কাজ করলেও মাত্র অর্ধেক রোগীকেই পরিষেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।’
তিনি জানান, ক্যান্সার রোগীদের মতো ব্রেন টিউমার অপারেশনের রোগীদেরও অস্ত্রোপচার পিছিয়ে গেলে প্রাণসংশয় হতে পারে। ওই হাসপাতালেরই অর্থোপেডিক বিভাগের শিক্ষক-চিকিৎসক কিরণকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘মাঝে কয়েক দিন প্ল্যানড সার্জারি বন্ধ থাকার পরে বুধবারই দু’টো অপারেশন হয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকে অস্ত্রোপচার আরও বাড়বে। কিন্তু গত কয়েক দিনেই ব্যাক-লগ প্রায় ১১০ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ক্লিয়ার করতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরে মাস দেড়েক লেগে যেতে পারে।’
ওই হাসপাতাল সূত্রে খবর, পেডিয়াট্রিক সার্জারিতেও ৫-৬টি করে ওটি করার চেষ্টা চলছে রোজ। এনআরএসের এক প্রশাসকের কথায়, ‘যাঁদের অপারেশন স্থগিত হচ্ছে, তাঁদের একাংশ ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। অনেকে আবার হাসপাতালে থেকে অপারেশন শেষ করে যেতে চাইছেন। ব্যাক-লগ মেটানোর সময়ে হাসপাতালে থেকে যাওয়া এই রোগীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।’
কামারহাটির সাগর দত্ত হাসপাতালে গড়ে দৈনিক ৩৫-৪০টির বদলে এখন ১৫-১৬টি করে অপারেশন হচ্ছে। এর অর্ধেকই সিজ়ার। তবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে আন্দোলনের ভরকেন্দ্র আরজি করে। ওই হাসপাতালের যে ১০-১২টি বিভাগে যাবতীয় অপারেশন হয়ে থাকে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে প্লাস্টিক সার্জারি ও অর্থোপেডিক বিভাগে। গোটা হাসপাতালে মাসে গড়ে ৩০০০ অপারেশন হয় সিজ়ার বাদে। গত ১২ দিনে সেখানে শুধু সিজ়ারই হয়েছে। বাকি পরিকল্পিত অস্ত্রোপচার প্রায় হয়ইনি। ফলে বাতিল অপারেশনের সংখ্যা প্রায় হাজার ছুঁয়েছে।