এই সময়: আরজি কর হাসপাতালের তরুণী-চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের বিচার চেয়ে নজিরবিহীন প্রতিবাদ দেখছে বাংলা। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’-এর স্বর ছড়িয়ে গিয়েছে বাংলা পেরিয়ে ভিন রাজ্য, এমনকী ভিন দেশেও। কখনও মেয়েরা রাত দখলের ডাক দিয়েছেন। চিকিৎসাকর্মীদের পাশাপাশি প্রায় প্রতিদিনই আলাদা আলাদা ভাবে পথে নামছেন শিল্পী, আইনজীবী, ফটোগ্রাফাররা, ছাত্র সমাজ, স্কুল-কলেজের প্রাক্তনী, সঙ্গীতশিল্পী বা বাচিক শিল্পীরা।দলমত নির্বিশেষে বিচারের দাবিতে সাধারণ নাগরিকদের প্রতিবাদের রেশ কমার লক্ষণ নেই। এমনকী ডার্বি ম্যাচ বন্ধের প্রতিবাদের স্বরও মিশেছে আরজি করের জাস্টিসের দাবিতে। কলকাতা ময়দানের চির প্রতিদ্বন্দ্বী দুই ক্লাবের সমর্থকরাও একে অন্যের সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রতিবাদ করেছেন।
এত ভিন্ন স্বর, ভিন্ন মতের মানুষ একটানা নিজেদের একসুরে বাঁধছেন কেন?
নাগরিক সমাজ থেকে আন্দোলনকারীরা এর ব্যাখ্যায় একাধিক মতামত তুলে আনছেন। তাঁদের বক্তব্যের মধ্যে মূলত চারটি দিক উঠে আসছে। প্রথমত, খাস কলকাতার একটি সরকারি হাসপাতালে কর্তব্যরত এক চিকিৎসকের সঙ্গে এমন ভয়ানক ঘটনা ঘটে যাওয়ায় মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে।
যে চিকিৎসক সাধারণ মানুষের কাছে ঈশ্বরতুল্য, সেই কমিউনিটিরই একজন হাসপাতালের মধ্যে এমন নির্যাতনের শিকার হলে বাকিদের নিরাপত্তা কোথায়— এই প্রশ্নেই বহু মানুষ আতঙ্কিত, হতাশাগ্রস্ত এবং ক্ষুব্ধ। দ্বিতীয়ত, ঘটনার পর থেকে আরজি কর কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ-প্রশাসনের একাংশের ভূমিকা ও ঘটনাপরম্পরা মানুষের সন্দেহ বাড়িয়ে তুলেছে। যাতে ইন্ধন জুগিয়েছে আরজি কর হাসপাতালে বহিরাগতদের হামলার ঘটনাও।
তৃতীয়ত, যুক্তিসঙ্গত ভাবেই হোক অথবা ফেক নিউজ়ের মাধ্যমে— নানা তথ্যের বিস্ফোরণে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে অন্য নানা ইস্যুতে জমতে থাকা ক্ষোভ এই আন্দোলনের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে বলেও মনে করছেন বিশিষ্টদের একাংশ। চতুর্থত, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক জনবিপ্লব ও ছাত্র সমাজের আন্দোলন এ পার বাংলার উপরে প্রভাব ফেলেছে।
রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্র হাইকোর্টের আইনজীবীদের মিছিলে পা মিলিয়েছেন। তাঁর মতে, ‘আরজি করের মর্মান্তিক ঘটনার পর থেকে প্রশাসনের একাংশের ব্যর্থতার নানা ছবি ধরা পড়েছে। কর্তব্যরত চিকিৎসকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা থেকে আরজি করের হামলা ঠেকানো— কোনও কিছুতেই পুলিশ-প্রশাসন জনতার কাছে নিজেদের ‘ক্রেডিবল’ প্রমাণ করতে পারেনি। ফলে এই ঘটনায় প্রশাসনের উপরে জমে থাকা ক্ষোভ বাইরে চলে আসছে।’
নাট্যব্যক্তিত্ব কৌশিক সেন, অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়রা এই জন বিস্ফোরণের নেপথ্যের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন রাজনৈতিক নানা ভুল পদক্ষেপকে। কৌশিকের মতে, ‘ঘটনার পর থেকে রাজ্য প্রশাসনের নানা ফাঁক নজরে পড়ছে। কখনও অকুস্থল অর্থাৎ সেমিনার রুমের কাছেই নির্মাণকাজ, কখনও প্রিন্সিপাল সন্দীপ ঘোষ ইস্তফা দেওয়ার পরেও তাঁকে শহরেরই আর একটি হাসপাতালে একই পদে নিয়োগ করার মতো একাধিক পদক্ষেপ মানুষের ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।’
পরমব্রতর সংযোজন, ‘এই সময়ে যখন এত মানুষ প্রতিবাদে সামিল হয়েছে, তখন যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের উচিত মানুষের ক্ষোভ শোনা, ভুলগুলোকে স্বীকার করা। তার পরিবর্তে পাল্টা মিছিল করে, ধর্না দিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে আরও উস্কে দেওয়া হয়েছে।’ সাহিত্যিক তিলোত্তমা মজুমদারও প্রায় এমনই মনে করেন। তবে তিনি যুক্ত করছেন বাংলাদেশের প্রসঙ্গ।
তাঁর কথায়, ‘প্রতিবেশী দেশে যা ঘটেছে, সেখানকার প্রভাব ও অনুপ্রেরণা এই আন্দোলনকে গতি দিয়েছে। সে দেশেও সরকারের নানা পদক্ষেপ আগুনে ঘি ঢেলেছে। ফলে এখানকার বিরোধীদের কথায় নয়, বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে এ পারের সাধারণ মানুষও দেখছেন এ ভাবেই মাঠে নেমে পড়া যায়।’
নাট্যব্যক্তিত্ব সোহিনী সেনগুপ্ত থেকে প্রেসিডেন্সির সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক উপল চক্রবর্তীরা আবার মনে করেন, একজন মহিলা চিকিৎসকের উপরে এমন ভয়ঙ্কর আক্রমণই মানুষের ধৈর্যচ্যুতির অন্যতম কারণ। সোহিনীর কথায়, ‘বহু মানুষের কাছেই চিকিৎসকরা ভগবানের সমান। রোগমুক্তির পর মরণাপন্ন মানুষকে ডাক্তাররা নতুন জীবন দেন। তেমনই একজন ডাক্তার ৩৬ ঘণ্টা ডিউটি করে একটু ঘুমোতে গিয়েছিলেন, তাও নিজেরই কর্মক্ষেত্রে। এইটুকু নিরাপত্তা কি তাঁর প্রাপ্য ছিল না?’
উপলের যুক্তি, ‘শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গত কয়েক বছর ধরে দুর্নীতির অভিযোগ দেখেছে। কিন্তু তাতে পথে নামার কোনও প্রয়োজন তাঁরা বোধ করেননি শ্রেণিগত বিন্যাসের কারণেই। কিন্তু যখন তাঁরা দেখলেন, নোব্ল প্রফেশনের একজন মানুষকেও নিরাপত্তা দেওয়া যাচ্ছে না, তখন আর কেউ চুপ করে বসে থাকতে চাননি।’
মেয়েদের রাত দখলের ডাকের প্রথম কারিগর রিমঝিম সিনহা অবশ্য মনে করছেন, দেশের নানা প্রান্তে মেয়েদের উপরে ঘটে চলা ক্রমবর্ধমান এই অত্যাচারকে সবক শেখাতেই মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। রিমঝিমের কথায়, ‘কে বলতে পারে, কাল হয়তো আমি, পরশু অন্য কেউ টার্গেট হব না!’