রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর বড় প্রিয়। রবীন্দ্রনাথের কথা ও গানের আনুষঙ্গিকে মুড়েই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে স্মরণ করল সিপিএম। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে বৃহস্পতিবার যখন ওই স্মরণ-সভা হচ্ছে, বাইরে তখন আর জি কর-কাণ্ডে লাগাতার প্রতিবাদ চলছে। প্রথমে পিছিয়ে থাকলেও গতি বাড়িয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে বিজেপি। আর গোটা সামাজিক পরিমণ্ডলে প্রাথমিক ভাবে সাড়া জাগিয়ে সিপিএম কেন ‘ইন্ডোরে’ চলে গেল, সেই প্রশ্ন ঘুরে বেড়াল স্মরণ অনুষ্ঠানের আনাচে-কানাচে, দলের অন্দরে। স্মরণের মঞ্চ থেকে সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্বকেও বার্তা দিতে হল পরিস্থিতি বদলের লক্ষ্যে লড়াই চালানোর।
আর জি করে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পরে নিহত চিকিৎসক-ছাত্রীর দেহ নিয়ে শববাহী গাড়ি পুলিশ যখন বার করে নিয়ে যেতে চাইছিল, মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সিপিএমের যুব সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সেই গাড়ি আটকেছিলেন। তখন থেকেই ঘটনা নিয়ে হইচইয়ের সূত্রপাত। সে দিনই ছিল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেবের শেষযাত্রা। নেতাজি ইন্ডোরে এ দিন এক যুব কর্মীর আঁকা বুদ্ধদেবের প্রতিকৃতি প্রয়াত নেতার স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য ও সন্তান সুচেতনের হাতে তুলে দিয়েছেন মীনাক্ষী। সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে দলের রাজ্য কমিটির এক সদস্যের মন্তব্য, ‘‘আন্দোলনে থাকতে হবে বলে রাজ্য কমিটির বর্ধিত অধিবেশন (কল্যাণীতে আজ, শুক্রবার শুরু হওয়ার কথা ছিল) স্থগিত করা হল। কিন্তু তার পরে পাঁচ দিন কার্যত আমরা ঘরে বসে থাকলাম! এটা তো সত্যিই রাস্তায় থাকার সময়।’’ দলের একটি সূত্রের ইঙ্গিত, আজ রাজ্য কমিটির বৈঠকে পরবর্তী আন্দোলন কর্মসূচি ঠিক হতে পারে। দলের মধ্যেই চাপ তৈরি হওয়ায় আজই অবশ্য শ্যামবাজার ‘দখলমুক্ত’ করার ডাক দিয়ে কলেজ স্কোয়ার থেকে মিছিলের কর্মসূচি নিয়েছে ছাত্র সংগঠন এসএফআই। তবে এ দিন রাত পর্যন্ত পুলিশ মিছিলের অনুমতি দেয়নি।
স্মরণ-সভায় বক্তা ছিলেন প্রবীণ নেতা বিমান বসু, সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্র এবং রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। দিল্লির এম্স থেকেই ভিডিয়ো-বার্তায় দলের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি আক্ষেপ করেছেন তাঁর ৫০ বছরের সঙ্গী ‘বুদ্ধদা’র শেষ যাত্রা ও স্মরণ অনুষ্ঠানে হাজির হতে না পারায়। বলেছেন, ‘‘বুদ্ধদেবের দিশা সঠিক ছিল। সেই দিশা আজ আরও প্রাসঙ্গিক হয়েছে। রোজগার, কাজের জন্য তাঁর লক্ষ্য বাস্তবায়িত হলে বাংলায় শিল্পায়ন হত। কাজের জন্য দলে দলে বাংলার যুবকদের বাইরের রাজ্যে যেতে হত না।’’ তবে স্মরণ-সভাতেও গ্যালারি থেকে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান মনে করিয়ে দিয়েছে, বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরে এখন মনোভাব কেমন!
‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’-এর প্রসঙ্গ টেনেই বিমানবাবু বলেছেন, ‘‘কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করছেন, পরিস্থিতি কি পরিবর্তন হবে? শুধু এই প্রশ্ন করে গেলে চলবে না। সব ধরনের ন্যায়ের জন্যই তো বুদ্ধ বা আমরা সবাই রাজনীতি করতে এসেছি। যাঁরা পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে চাই বা চান, তাঁদের নিজেদের মতো করে কাজটাও করতে হবে।’’ সেলিমও উল্লেখ করেছেন, বুদ্ধদেব যে ডিওয়াইএফআইয়ের প্রথম রাজ্য সম্পাদক ছিলেন, সেই যুব সংগঠনের আধুনিক প্রজন্মই আর জি কর-কাণ্ডে প্রথম পথে নেমেছে। বাংলাকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর যে স্বপ্ন বুদ্ধদেব দেখেছিলেন, তার মধ্যে কোনও ‘অসততা’ ছিল না বলে মন্তব্য করে সেলিম তুলেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীরই তুলে যাওয়া স্লোগান— ‘এ লড়াই লড়তে হবে, এ লড়াই জিততে হবে’!
বামফ্রন্টের সব শরিক ছাড়াও এসইউসি, সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের নেতারা , প্রাক্তন নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন স্মরণ-সভায়। তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। ছিলেন কংগ্রেসের প্রদীপ ভট্টাচার্য, আব্দুল মান্নান, অমিতাভ চক্রবর্তী, সন্তোষ পাঠকেরা। সংস্কৃতি জগতের বহু ব্যক্তিত্বকেই দেখা গিয়েছে। শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। সঙ্গে ছিলেন তাঁর দাদা তথা সিএবি-র সভাপতি স্নেহাশিসও। সৌরভ বলেন, “খেলাপাগল মানুষ ছিলেন। ভাল খেললে কলকাতায় দেখাও করতেন। স্মরণ-সভায় এসেছি, কারণ সম্পর্ক সব কিছুর ঊর্ধ্বে। ওঁর স্ত্রী-সন্তান ভাল থাকুন।”