• ‘এফআইআর দায়ের করতে ১৪ ঘণ্টা দেরি কেন? এত ক্ষণ কী চলছিল?’ আরজি কর-কাণ্ডে প্রশ্নবাণ সুপ্রিম কোর্টের
    আনন্দবাজার | ২৩ আগস্ট ২০২৪
  • আর জি করের ঘটনায় তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে সিবিআইয়ের রিপোর্ট সুপ্রিম কোর্টে জমা পড়ল। কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার পরে এক সপ্তাহের বেশি কেটে গেলেও তদন্ত কত দূর এগিয়েছে, তা প্রকাশ্যে এল না। উল্টে সিবিআই অভিযোগ তুলল, অপরাধের ঘটনাস্থল বা ‘ক্রাইম সিন’-এ রদবদল করা হয়েছিল। সিবিআইয়ের রিপোর্টের ভিত্তিতে রাজ্য সরকার এ দিন ফের সুপ্রিম কোর্টের তিন কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়ল।

    আজ সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তুলেছে— এক, আর জি কর কাণ্ডে এফআইআর দায়ের করতে ১৪ ঘণ্টা দেরি হল কেন? দুই, আর জি কর হাসপাতালের অধ্যক্ষের উচিত ছিল সোজা কলেজে এসে এফআইআর দায়ের করা। তিনি কার সঙ্গে যোগাযোগে ছিলেন? তিন, অধ্যক্ষ ইস্তফা দেওয়ার পরেই কেন তাঁকে অন্য মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করা হল? যখন তদন্ত চলছে, তখন এই নিয়োগের উদ্দেশ্য কী ছিল? প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের মন্তব্য, ‘‘এই তিনটি বিষয়েরই কোনও যৌক্তিকতা নেই।’’ ৫ সেপ্টেম্বর ফের এই মামলার শুনানি হবে।

    সিবিআই আজ আর জি করে প্রাক্তন অধ্যক্ষ-সহ কয়েক জনের পলিগ্রাফ টেস্টের জন্য আবেদন জানায়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, শিয়ালদহের অতিরিক্ত মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটকে শুক্রবার বিকেল ৫টার মধ্যে এ বিষয়ে রায় দিতে হবে। নিম্ন আদালতের সেইঅনুমতি পরে পেয়েও গিয়েছে সিবিআই। সুপ্রিম কোর্ট নিজে প্রধান অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের শারীরিক পরীক্ষার রিপোর্ট দেখতে চেয়েছিল আজ। সেই সময়ে রাজ্যের তরফে জানানো হয়, পুলিশের কেস ডায়েরির মধ্যেই এই রিপোর্ট রয়েছে। সিবিআইয়ের তরফে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা অভিযোগ তোলেন, ‘‘এমন কোনও রিপোর্টের কথা আমার জানাই নেই। আমাদের তা দেওয়া হয়নি।’’ রাজ্যের আইনজীবী কপিল সিব্বল বলেন, ‘‘কেস ডায়েরি সিবিআইকে দেওয়া হয়েছে।’’ তখন মেহতা অভিযোগ তোলেন, ‘‘আমরা ঘটনার পঞ্চম দিনে তদন্তে নেমেছি। সিবিআই তদন্ত শুরু করাটাই চ্যালেঞ্জ ছিল। অপরাধের ঘটনাস্থলে রদবদল করা হয়েছিল।’’

    প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্রর বেঞ্চের প্রশ্ন, গত ৯ অগস্ট সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে আর জি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হয়। ১০টা ১০ মিনিটে টালা থানায় খবর যায়। যার ভিত্তিতে একটি জেনারেল ডায়েরি হয়। কিন্তু থানায় অস্বাভাবিক মৃত্যুর রিপোর্ট দায়ের করতে রাত সাড়ে ১১টা বেজে গেল কেন? এফআইআর দায়ের হয়েছে আরও পরে, রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে। সব মিলিয়ে দেহ উদ্ধারের ১৪ ঘণ্টা পরে কেন এফআইআর দায়ের হল?

    প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘একটা বিষয় খুবই চিন্তার। সকাল ১০টা ১০ মিনিটে মৃত্যুর খবর থানায় গিয়েছে। কিন্তু অপরাধের ঘটনাস্থল ঘিরে ফেলা, তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করার কাজ হয়েছে রাত ১১টা ৩০ মিনিটের পরে? এত ক্ষণ ধরে কী চলছিল?” বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালা প্রশ্ন তোলেন, অস্বাভাবিক মৃত্যুর রিপোর্ট দায়ের হয়েছে রাত ১১টা ৩০ মিনিটে। অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে তবেই মৃতদেহের ময়নাতদন্ত হয়। এ ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত হয়েছে সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিট থেকে ৭টা ১০ মিনিটের মধ্যে। তার পরে সৎকারের জন্য দেহ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। অস্বাভাবিক মৃত্যুর রিপোর্ট দায়ের হওয়ার আগেই কী ভাবে ময়নাতদন্ত করা হল?

    প্রধান বিচারপতি আরও প্রশ্ন করেন, রাত ১১টা ৩০ মিনিটে যে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের হল, সেই মামলার নম্বর কী ভাবে বিকেল চারটের সময় ম্যাজিস্ট্রেটের প্রাথমিক তদন্তের রিপোর্টে চলে এল? বিচারপতি পারদিওয়ালা বলেন, ‘‘জীবনে অপরাধের এমন তদন্ত দেখিনি। কলকাতা পুলিশ যে প্রক্রিয়া মেনে তদন্ত করেছে, তা গত তিরিশ বছরের পেশাগত জীবনে চাক্ষুষ করিনি।’’ সিবিআইয়ের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রথমে মৃতার পরিবারকে তাঁদের মেয়ে অসুস্থ বলে জানানো হয়। তার পরে সহকারী সুপার (নন-মেডিক্যাল) জানান, চিকিৎসক আত্মহত্যা করেছেন। বিচারপতি পারদিওয়ালা জানতে চান, এই সহকারী সুপার পুরুষ না মহিলা? ‘মহিলা’ জানার পরে বলেন, ‘‘ওঁর আচরণ ও ভূমিকা খুবই সন্দেহজনক।’’

    তদন্ত কত দূর এগিয়েছে জানিয়ে সিবিআই আজ মুখ-বন্ধ খামে রিপোর্ট জমা দিয়েছে। ১৪ অগস্ট রাতে আর জি করে ভাঙচুরের ঘটনায় কলকাতা পুলিশের তদন্তের অগ্রগতির রিপোর্টও জমা পড়েছে। রাজ্য সরকার কলকাতা পুলিশের তদন্তের অগ্রগতির রিপোর্ট সিবিআইয়ের হাতে দিতে রাজি হয়নি। সিবিআইয়ের তরফে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা আজ তদন্ত নিয়ে আদালতে কিছু বলেননি। তবে তিনি অভিযোগ তুলেছেন, পুলিশের কেস ডায়েরি অনুযায়ী থানায় যখন খবর গিয়েছিল, তখনও বলা হয়েছিল, সংজ্ঞাহীন অবস্থায় একজন তরুণী চিকিৎসককে উদ্ধার করা হয়েছে। যদিও তার আগেই নির্যাতিতার মৃত্যু হয়েছে। মৃতার বাবা জোরাজুরি করায় এফআইআর দায়ের হয়। হাসপাতাল কোনও এফআইআর দায়ের করেনি।

    কপিল সিব্বল বিচারপতিদের এই প্রশ্নের ঝড় ও সিবিআইয়ের অভিযোগের মুখে যুক্তি দেন, কলকাতা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে সব দেখে দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটেই অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের করেছিল। সিবিআই জেনারেল ডায়েরি এন্ট্রির উপরে ভিত্তি করে রিপোর্ট তৈরি করেছে। তার জন্য বিভ্রান্তি হচ্ছে। রাত ১১টা ৩০ মিনিটে থানায় পুলিশ ফিরে যাওয়ার পরে রিপোর্ট লেখা হয়। তার পরে বাবা এফআইআর দায়ের করেন। তিনি অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। কিন্তু তার জন্য তদন্ত থেমে থাকেনি। বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের প্রাথমিক তদন্তের পরে ময়নাতদন্ত হয়। সমস্ত প্রক্রিয়ার ভিডিয়ো রেকর্ডিং করা হয়েছে। সমস্তটাই হয়েছে নিয়ম মেনে। অপরাধের ঘটনাস্থলে রদবদলের অভিযোগ নিয়ে সিব্বল বলেন, ‘‘তারও ভিডিয়ো রেকর্ডিং করা রয়েছে।” সিবিআইয়ের দিকে আঙুল তুলে সিব্বল বলেন, ‘‘সিবিআই এক সপ্তাহ ধরে কী তদন্ত করেছে, তা বলছে না। সেদিকে নজর না দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিয়ে পড়ে রয়েছে।’’ কিন্তু প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘এ সবের পরেও ওই প্রথম তিনটি বিষয়ের কোনও যৌক্তিকতা নেই।’’

    শুনানির সময় এক আইনজীবী অভিযোগ তোলেন, ‘‘ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছে ১৫০ গ্রাম বীর্য মিলেছে।’’ প্রধান বিচারপতি তাঁকে ধমকে বলেন, ‘‘সমাজমাধ্যম দেখে আদালতে কথা বলবেন না। আমাদের সামনে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট রয়েছে। কিসের ওজন ১৫০ গ্রাম, তা আমরা জানি।’’ সিব্বল বলেন, এমনও প্রচার করা হচ্ছে, যে সব আইনজীবী রাজ্যের হয়ে লড়ছেন, তাঁদের সুইস ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট রয়েছে!

    সুপ্রিম কোর্টে এ দিনের শুনানির পরে বিরোধী শিবির রাজ্য সরকারকে ফের আক্রমণ করেছে। বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘‘আত্মসম্মান বোধ থাকলে মুখ্যমন্ত্রী পদটা ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে বসে থাকতেন। কোনও অসুবিধা ছিল না। নিজের দলের অন্য কাউকে মুখ্যমন্ত্রী করুন।” সিপিএমের নেতা সুজন চক্রবর্তীর কটাক্ষ, ‘‘প্রতি পদে তথ্য-লোপাটের সব চেষ্টা ধরা পড়ে গিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের কাছে আমাদের রাজ্য বেইজ্জত হল।’’ অন্য দিকে তৃণমূলের কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্যকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। নবান্ন অভিযান বলে যাঁরা প্ররোচনা ছড়াচ্ছেন, তাঁরা আশা করি খেয়াল রাখবেন যে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, রাজনীতি করবেন না।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)