এই সময়: ‘পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র সমাজ’ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের ডাকা নবান্ন অভিযান কর্মসূচিকে ঘিরে রাজনীতির পারদ চড়তে শুরু করেছে। বাম এবং তৃণমূলের ছাত্র সংগঠনগুলির অভিযোগ, ছাত্র সমাজ নয়, এই নবান্ন অভিযান ডেকেছে পদ্ম সমাজ। তাই তৃণমূল তো বটেই এমনকী বামেরাও এই ডাকের পাশে নেই।তবে কেবল বিজেপি বিরোধী প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলি বা তাদের ছাত্র সংগঠনগুলিই নয়, আরজি কর হাসপাতালে নির্যাতিতার বিচার চেয়ে যাঁরা প্রতিদিন নানা মিছিলে হাঁটছেন, তাঁদেরও সায় নেই এই নবান্ন অভিযানে। যে চিকিৎসক ও জুনিয়র ডাক্তাররা হাসপাতালে কর্মবিরতি চালাচ্ছেন তাঁদেরও একটা বড় অংশ নবান্ন অভিযানের সঙ্গে নেই। এমনকী মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিকেও মানছেন না আন্দোলনকারীদের অনেকে।
এই ঘটনায় বিজেপি নেতাদের অংশগ্রহণ নিয়ে দলের অন্দরেও বিভাজন রেখা প্রকট হয়ে উঠেছে। বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী যেভাবে প্রকাশ্যে ‘ছাত্র সমাজ’-এর ডাকা নবান্ন অভিযানে সামিল হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন, তার সঙ্গে সহমত নন বঙ্গ-বিজেপির অনেকেই। রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার শনিবার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, অরাজনৈতিক মিছিলে রাজনৈতিক নেতাদের না যাওয়াই ভালো।
২৭ তারিখ ‘ছাত্র সমাজ’-এর কর্মসূচিতে সামিল হওয়ার বার্তা ক’দিন আগে দিয়েছিলেন শুভেন্দু। শনিবার উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি পুলিশকেও এক হাত নেন। বিরোধী দলনেতার দাবি, ওই কর্মসূচি বানচাল করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে রাজ্য পুলিশ। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের বিভ্রান্ত করতে বিভিন্ন জেলায় পুলিশ ভুয়ো খবর ছড়াচ্ছে বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি।
এদিকে, ‘ছাত্র সমাজ’-এর কর্মসূচি নিয়ে শুভেন্দুর এই উৎসাহ বাঁকা চোখে দেখছেন বিজেপিরই একাংশ। সরাসরি নন্দীগ্রামের বিধায়কের বিরোধিতা না করলেও সুকান্ত এদিন ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছেন ‘ছাত্র সমাজ’-এর আন্দোলনের সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলা উচিত। তিনি বলেন, ‘এই মিছিলে রাজনৈতিক নেতাদের দূরে থাকাই ভালো। অরাজনৈতিক মিছিল অরাজনৈতিক থাকাই বাঞ্ছনীয়।’
এ দিকে যে প্রতিবাদীরা প্রতিদিন রাস্তায় নেমে নির্যাতিতার বিচার চাইছেন তাঁদেরও অনেকের সায় নেই এই নবান্ন অভিযানে। তাঁদের অভিমত, তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় বিচারের দাবির সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলকে যাঁরা মিলিয়ে ফেলছেন, তাঁরা আসলে বিচারের দাবিকে পিছনে ফেলে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থই চরিতার্থ করতে চাইছেন।
অনেকেই সহমত নন মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবির সঙ্গেও। যেমন, আজ, রবিবার রামলীলা ময়দান থেকে এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত একটি নাগরিক মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছে। সেই মিছিলের স্লোগান--‘দফা তিন দাবি তিন, মুখ্যমন্ত্রী জবাব দিন!’
মিছিলের অন্যতম আহ্বায়ক শতাব্দী দাসের বক্তব্য, ‘আমরা মনে করি না মুখ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করালেই দাবি আদায় হবে। বরং উনি মানুষের ভোটে জয়ী হয়েছেন। তাই তাঁকে দায়িত্ব নিতে হবে। মানুষের দাবিগুলিকে ওঁকেই মান্যতা দিতে হবে।’
ওই মিছিলের দাবি, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে হবে, দিনে-রাতে মেয়েদের এবং প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে তাঁদের সমমর্যাদা দিতে হবে।
মেয়েদের রাত দখলের ডাক প্রথম দিয়েছিলেন গবেষক রিমঝিম সিনহা। তাঁর বক্তব্য, ‘২৭ তারিখে অভিযান কোনও ছাত্র সমাজের ডাকে নয়, ওটা পদ্ম-সমাজের ছদ্মবেশ। আমরা ওই ডাকের সঙ্গে সহমত নই।’ প্রেসিডেন্সির ছাত্রী বরিষণ রায় মনে করিয়ে দিয়েছেন, ২৭ তারিখ কিন্তু নেট পরীক্ষাও রয়েছে। আন্দোলনরত ডাক্তাররাও এই অভিযানের সঙ্গে পুরোপুরি সহমত হতে পারছেন না।
আরজি কর হাসপাতালের আন্দোলনকারী চিকিৎসক সামস মুসাফিরের বক্তব্য, ‘৯ তারিখের ঘটনার পরে বহু মানুষ রাস্তায় নামছেন প্রতিদিন। আমরা সকলকে স্বাগত জানাই। কিন্তু আমাদের আন্দোলন যেমন দলীয় সংস্রবহীন ভাবে চলছে, সে ভাবেই চলবে। এই আন্দোলন কোনও রাজনৈতিক স্বার্থে বা ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে চলছে না।’
এ দিকে শনিবার বেশ কিছু তথ্যপ্রমাণ সামনে এনে বাম-কর্মী অবিন দত্তগুপ্ত সামাজিক মাধ্যমে দাবি করেছেন, শুক্রবার যাঁরা ছাত্র সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন, তাঁদের মধ্যে একজন যাদবপুর শ্রীকলোনি এলাকায় সক্রিয় বিজেপি কর্মী এবং আরএসএসের সদস্য।
এই দাবির সত্যতা যাচাই করেনি ‘এই সময়’। অন্যদিকে, তৃণমূল কাউন্সিলার অরূপ চক্রবর্তীও নবদ্বীপের এক বিজেপি কর্মীকে চিহ্নিত করে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষের কটাক্ষ, ‘বিজেপির পতাকা মানুষ রিজেক্ট করেছে। তাই ছদ্মবেশে নবান্ন অভিযানের কর্মসূচি নিয়েছে।’