ধর্ষণ-খুন ঘিরে হুলস্থুলই প্রকাশ্যে এনে দিল ‘দুর্নীতি’! তার পরেই সিট, আখতার হাই কোর্টে, এবং সিবিআই
আনন্দবাজার | ২৫ আগস্ট ২০২৪
কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে! আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুনের অভিযোগই কি টান দিল সুতোয়! এই ঘটনার সূত্র ধরেই প্রকাশ্যে এল সেখানকার দুর্নীতির অভিযোগ, যা নিয়ে এর আগেও তোলপাড় হয়েছে সেই হাসপাতালে।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ নিয়ে এর আগেও বহু বার বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে পড়ুয়াদের বিক্ষোভ, অনশন চলেছে। কিন্তু সেই আঁচ কলেজের বাইরে এসে পৌঁছয়নি। অভিযোগ উঠেছে। পড়ুয়াদের দাবি, সমস্যার সমাধান হয়নি কখনও। এ বার চিকিৎসকের মৃত্যুতে লাভার মতো বাইরে বেরিয়ে এল সেই ক্ষোভ। তা দমন করতে নামল রাজ্য সরকার। অভ্যন্তরীণ আর্থিক দুর্নীতির তদন্তের জন্য গঠন করল বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)। তাতেও কাজ হল না। কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তে নামল সিবিআই। শুরু হল হাসপাতালের কর্মী, আধিকারিক, প্রাক্তন কর্তাদের বাড়ি তল্লাশি, জিজ্ঞাসাবাদ। রবিবার সন্দীপ ঘোষ-সহ হাসপাতালের একাধিক আধিকারিক, কর্মচারীর বাড়িতে হানা দিলেন তদন্তকারীরা। মোট ১৫ জায়গায় হানা দিয়ে চলছে জিজ্ঞাসাবাদ।
২০২১ সালের অক্টোবর মাসে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়ারা বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন। সে সময়ও তাঁদের অন্যতম দাবি ছিল, হস্টেলে ডাক্তারি ছাত্রীদের নিরাপত্তা। প্রশাসনিক কাজকর্মে স্বচ্ছতা নেই বলেও অভিযোগ তুলেছিলেন আন্দোলনকারীরা। সরাসরি আঙুল তুলেছিলেন তৎকালীন অধ্যক্ষের দিকে। সে সময়ও ওই পদে ছিলেন সন্দীপ। ওই বছর দুর্গাপুজোর সময় বেলগাছিয়া সেতুতে বিক্ষোভ দেখান তাঁরা। আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল, তাঁদের অভিযোগ নিয়ে কোনও সক্রিয়তা দেখাননি কর্তৃপক্ষ। চলতি বছর ৯ অগস্ট আরজি কর হাসপাতাল থেকে উদ্ধার হয় মহিলা চিকিৎসকের দেহ। হাসপাতালে নিরাপত্তার অভাবের অভিযোগ তুলে আবার সরব হন পড়ুয়া, জুনিয়র ডাক্তারেরা। কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তোলেন। কর্মবিরতির ডাক দেন তাঁরা। চাপে পড়ে অধ্যক্ষ পদ থেকে ইস্তফা দেন সন্দীপ। হাসপাতালের সুপারের পদ থেকে সরানো হয়ে সঞ্জয় বশিষ্ঠকে। তার পরেও বিক্ষোভ থামেনি। প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ তুলতে থাকেন পড়ুয়া, প্রাক্তন পড়ুয়া, এমনকি, প্রাক্তন ডেপুটি সুপার। আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে। রাজ্য সরকার এই নিয়ে তদন্তের জন্য সিট গঠন করে। তাতেও দমেনি ক্ষোভ। দুর্নীতির অভিযোগ তুলে এবং কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তের আর্জি জানিয়ে কলকাতা হাই কোর্টে দু’টি আবেদন জমা পড়ে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে তদন্তভার হাতে নেয় সিবিআই। এফআইআর করে সন্দীপের বিরুদ্ধেও। এর আগে চিকিৎসকের মৃত্যুর তদন্তভার হাতে নিয়েছে সিবিআই। হেফাজতে নিয়েছে ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারকে। এই ঘটনায় হাসপাতালের কেউ জড়িত রয়েছেন বলে এখন পর্যন্ত সিবিআইয়ের তরফে কিছু জানানো হয়নি। তবে সেই সূত্র ধরে হাসপাতালের আর্থিক দুর্নীতির যে অভিযোগের তদন্ত করছে তারা, সেই সংক্রান্ত এফআইআরে নাম রয়েছে সন্দীপের।
গত ৯ অগস্ট সকালে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগের চার তলার সেমিনার হল থেকে উদ্ধার হয় মহিলা চিকিৎসকের দেহ। অভিযোগ ওঠে, ধর্ষণ এবং খুন করা হয়েছে তাঁকে। উত্তাল হয়ে ওঠে আরজি কর হাসপাতাল। কর্মবিরতির ডাক দেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। তখন থেকেই বার বার আঙুল তোলেন কর্তৃপক্ষের দিকে। অধ্যক্ষ পদ থেকে সন্দীপের অপসারণের দাবি তোলেন। আন্দোলনকারীদের দাবি, নিরাপত্তার অভাব রয়েছে হাসপাতালে। ওই রাতে চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে। কলকাতা পুলিশের ফোর্থ ব্যাটালিয়নের ব্যারাক থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাঁকে। সেই গ্রেফতারির পরেও পড়ুয়াদের আন্দোলন থামেনি। চাপে পড়ে অধ্যক্ষ পদ থেকে ইস্তফা দেন সন্দীপ। সন্দীপকে ন্যাশনাল মেডিক্যালে সমপদে বসিয়েছিল স্বাস্থ্য ভবন। তা নিয়েও প্রতিবাদ শুরু হয়। তবে হাই কোর্টের নির্দেশে নয়া দায়িত্ব গ্রহণ করা হয়নি। ছুটিতে যেতে হয় তাঁকে। তার মাঝেই ১৩ অগস্ট কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার তদন্তভার হাতে নেয় সিবিআই। এই সূত্র ধরে আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপকে ম্যারাথন জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকে। সিজিও দফতরে প্রায় প্রতি দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বসিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকেন সিবিআইয়ের আধিকারিকেরা। আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগও আরও বেশি করে মাথাচাড়া দিতে থাকে।
এর মাঝেই গত ১৬ অগস্ট আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের আর্থিক অনিয়ম নিয়ে তদন্তের জন্য সিট গঠন করে রাজ্য সরকার। নেতৃত্বে ছিলেন আইপিএস অফিসার প্রণব কুমার। রাজ্য পুলিশের সিটের উপর আস্থা নেই জানিয়ে প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আইনজীবী সুস্মিতা সাহা দত্ত। হাই কোর্টে তাঁর বক্তব্য ছিল, হাসপাতালের ওই আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে রাজ্য সরকার একটি সিট বা বিশেষ তদন্তকারী দল তৈরি করেছে ঠিকই, কিন্তু সেই সিট গঠন করা হয়েছে জনগণের চোখে ‘ধুলো’ দেওয়ার জন্য। আদতে তারা তদন্তের কাজ করছে না। তাই হাই কোর্ট এই বিষয়ে পদক্ষেপ করে দ্রুত শুনানির ব্যবস্থা করুক। বক্তব্য শোনার পর মামলা দায়ের করার অনুমতি দেয় প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ। হাই কোর্টে আর একটি আবেদন করেছিলেন আরজি কর হাসপাতালের প্রাক্তন ডেপুটি সুপার আখতার আলি। তিনিই হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ আনেন। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে একাধিক বেনিয়মের তত্ত্ব আদালতে তুলে ধরেছিলেন আখতারের আইনজীবী তরুণজ্যোতি তিওয়ারি। মর্গ থেকে দেহ উধাও হওয়ার অভিযোগ থেকে শুরু করে ‘মেডিক্যাল ওয়েস্ট’ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরেছেন। তিওয়ারি হাই কোর্টে জানান, আরজি করের আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডির তদন্ত চান তাঁরা। ওই আবেদন করা হয় বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজের এজলাসে। আখতার তাঁর নিরাপত্তার আবেদনও করেছিলেন। বিচারপতি ভরদ্বাজ মামলা দায়েরের অনুমতি দেন। এর পরেই আরজি করের আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে দ্বিতীয় আবেদনটি জমা পড়ে প্রধান বিচারপতি শিবজ্ঞানমের এজলাসে।
গত শুক্রবার বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজের একক বেঞ্চ জানিয়েছিল, একাধিক সংস্থা তদন্ত করলে বিষয়টি আরও জটিল এবং সময়সাপেক্ষ হতে পারে। এর পরেই সিবিআইকে আর্থিক দুর্নীতি মামলার তদন্তভার দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল উচ্চ আদালত। শনিবার সকালে ওই মামলার নথিপত্র তাদের হাতে তুলে দেয় রাজ্য সরকারের সিট। কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে সেই কাজ করে তারা। এর পর আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের আর্থিক দুর্নীতি মামলায় এফআইআর দায়ের করে সিবিআই। নিজ়াম প্যালেসে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দুর্নীতি দমন শাখা ওই এফআইআর দায়ের করেছে। প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপের বিরুদ্ধেও হয়েছে এফআইআর। এফআইআর দায়েরের পরেই আর্থিক দুর্নীতি মামলায় সক্রিয় হয় সিবিআই।
রবিবার সকালে আরজি কর হাসপাতালের একাধিক কর্তার বাড়িতে হানা দেয় সিবিআই। কেষ্টপুর, হাওড়া, এন্টালিতে কেন্দ্রীয় সংস্থার একটি করে দল গিয়েছে। আরজি করের ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগের কর্তা দেবাশিস সোমের বাড়ি রয়েছে কেষ্টপুরে। এন্টালিতে রয়েছে হাসপাতালের প্রাক্তন সুপার সঞ্জয় বশিষ্ঠের বাড়ি। সেখানে পৌঁছে গিয়েছেন সিবিআই আধিকারিকেরা। এ ছাড়া, হাওড়ার একটি জায়গায় বিপ্লব সিংহ নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে গিয়েছে সিবিআই। তিনি হাসপাতালে চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহকারী হিসাবে কাজ করেন। আরজি করে আর্থিক অনিয়মের যে অভিযোগ করেছিলেন হাসপাতালের প্রাক্তন অতিরিক্ত সুপার আখতার আলি, তাতে এঁদের নাম রয়েছে। বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছেন সিবিআই আধিকারিকেরা। বেলগাছিয়ার জেকে ঘোষ রোডে এক ক্যাফে মালিকের বাড়িতে গিয়েছে সিবিআইয়ের অন্য একটি দল। এ ছাড়া, সিবিআইয়ের একটি দল আরজি কর হাসপাতালেও গিয়েছে বলে খবর। অন্তত ১৫ জনের বাড়িতে সিবিআই গিয়েছে।