‘পুলিশ… তোমার মেয়েও হচ্ছে বড়’ স্লোগান নিয়ে বার্তা-বিতর্ক
এই সময় | ২৬ আগস্ট ২০২৪
কখনও স্লোগান। কখনও জমায়েত। কখনও মিছিল। দাবি একটাই — ‘সারা বাংলার একই স্বর, জাস্টিস ফর আরজি কর।’ যদিও অনেকেই মনে করছেন, নিরাপদ সমাজ, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও ডাক্তারের ধর্ষণ-খুনে ন্যায় বিচারের দাবিতে ১৪ অগস্ট প্রথম যে ‘রাত দখলের’ ডাক দিয়েছিলেন মহিলারা, সেখান থেকে আন্দোলনের অভিমুখ কিছুটা হলেও বদলছে।তবে গত ১৫ দিনে যেখানে কোনও বদল আসেনি, তা হলো ‘দলদাস’ পুলিশকে তাদের ‘ন্যক্কারজনক ভূমিকার’ জন্য কাঠগড়ায় তোলা। তারই মধ্যে দু’টি স্লোগান হু হু করে ছড়িয়েছে ও লক্ষ লক্ষ ‘লাইক’ পেয়েছে, যা নিয়ে চলছে বিতর্ক।
কী সেই স্লোগান?
‘পুলিশ তুমি যতই মারো, তোমার মেয়েও হচ্ছে বড়’ ও ‘পুলিশ তুমি চিন্তা করো, তোমার মেয়েও হচ্ছে বড়।’ — এখানেই অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, অন্যায়-অপরাধের প্রতিবাদ করতে গেলে একটা নির্দিষ্ট পেশার মানুষের শিশুকন্যাদের উদ্দেশে এই কথা বলা কি ঠিক? বিচার চাওয়ার মধ্যে কি প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসার ইঙ্গিত থাকা উচিত?
একটা অংশ বলছে, আন্দোলনের ধর্ম অন্যায়ের প্রতিবাদ, শিশু-মহিলাদের কোনও প্রচ্ছন্ন ‘হুমকি’ দেওয়া নয়। অন্য অংশের মত, পুলিশ কিছু জাস্ট করেনি। তাঁদের বাড়ির মেয়ের সঙ্গে এ রকম ঘটনা ঘটলে কি তাঁরা এতটা ‘নিষ্ক্রিয়’ থাকতে পারতেন?
‘রাত দখল’-এ অংশগ্রহণকারী সমাজকর্মী শ্রীময়ী সেন রাম মনে করছেন, সুবিচার পেতে প্রতিহিংসার ইঙ্গিত থাকা উচিত নয়। তাঁর কথায়, ‘ঠান্ডা মাথায় বুঝতে হবে যে, প্রতিশোধের বহুমাত্রিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। আবেগের বশে এই সব বলা হলেও কখনওই সেখানে কোনও শিশুদের টেনে আনা উচিত নয়। এটা তো এক রকম উস্কানিই।’
কনসালট্যান্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট শতভিষা চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘এটি এমন ভাবে লেখা হয়েছে যেন পুলিশকে তাঁদের কন্যাসন্তানের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তাঁদের নিজের পিতৃ/মাতৃসত্তার এবং মনুষ্যত্বের দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করতে আহ্বান জানানো হচ্ছে। কিন্তু সেই বক্তব্য প্রচ্ছন্ন শাসানির ইঙ্গিতও কি বহন করছে না?’
আর কী বলছে পুলিশ? কন্যা সন্তানের বাবা ও রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষকর্তা বললেন, ‘আমার সত্যিই কিছু বলার নেই। এই সব স্লোগান থেকে মনে হচ্ছে, কিছু বিকৃত মানসিকতার মানুষকে অকারণে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।’ ডিআইজি পদমর্যাদার আর এক অফিসারের কথায়, ‘এখন মানুষের জীবন সমাজমাধ্যমে ক’টা লাইক আর কমেন্ট এল তার উপরে চলছে। চটজলদি রিচ বাড়াতে নানা অ্যাবিউসিভ শব্দ ব্যবহার করে এই সব স্লোগান দেওয়া হচ্ছে।’
তাঁর সংযোজন, ‘পুলিশ সব সময়েই প্রশাসনের সব থেকে বেশি ভিজ়িব্ল উইং। তাই পুলিশ ও তাদের পরিবারকে আক্রমণে একটা ইগো স্যাটিসফেকশন কাজ করে জনতার।’ তাঁর বক্তব্য, ‘পুলিশকর্মী ও তাঁদের পরিবারও ন্যায় বিচার চায়। কিন্তু আমজনতা যে ইনস্ট্যান্ট জাস্টিস চাইছেন, তার বৈধতা আমাদের দেশের সংবিধান দেয়নি।’
কলকাতা পুলিশের এক প্রাক্তন কমিশনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বললেন, ‘এই ঘটনা কলকাতা পুলিশের ইমেজকে কলুষিত করেছে। সে দায় একান্ত ভাবেই পুলিশের। সেই ক্ষোভ থেকেই এমন স্লোগান।’ তবে তাঁর প্রশ্ন, ‘ক’জন সাধারণ মানুষ প্রতিটি স্তরের পুলিশকর্মীর স্যাক্রিফাইস ও পরিশ্রম সম্পর্কে জানেন? বহু ক্ষেত্রে পুলিশে কাজ করা মা-বাবার সঙ্গে তাঁদের শিশু সন্তানের দেখা হওয়াই কঠিন। তাই জনা কয়েক উর্দিধারীর জন্য তাঁদের শিশুকন্যাদের প্রসঙ্গ তোলা অপরাধ।’
এসপি পদমর্যাদার দুই পুলিশকর্তার স্ত্রী-র বক্তব্য, ‘আমরাও মেয়ের মা। এই আন্দোলনে আমরাও আছি। কারণ এই সমাজ কারও নিরাপত্তা কোথাওই সুনিশ্চিত করতে পারেনি। তার অর্থ সব পুলিশ অপদার্থ বা দলদাস নয়।’