এই সময়: আরজি করে ধর্ষণ-খুনের মামলায় ন’দিনে প্রায় ১০২ ঘণ্টা সিবিআইয়ের স্পেশাল ক্রাইম ব্রাঞ্চের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয়েছে সন্দীপ ঘোষকে। ওই হাসপাতালে আর্থিক দুর্নীতির মামলায় রবিবার সিবিআইয়ের আর্থিক দুর্নীতিদমন শাখার অফিসারদের প্রায় ১২ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হলো আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষকে।দুর্নীতি মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে সন্দীপের নাম জোরালো ভাবে উঠছিল ধর্ষণ-খুনের ঘটনার পর থেকেই। শুধু সন্দীপকে জিজ্ঞাসাবাদ নয়, তাঁর বাড়িতে তল্লাশিও চালিয়েছে সিবিআই। তাঁর পাশাপাশি আরজি করের প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ সঞ্জয় বশিষ্ঠ, হাসপাতালের শিক্ষক-চিকিৎসক দেবাশিস সোম, ভেন্ডার বিপ্লব সিংহ-সহ আরও বেশ কয়েকজনের বাড়িতে এ দিন হানা দেয় সিবিআই। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্তভার নিয়ে রবিবার সকাল থেকে বেলেঘাটা, ট্যাংরা, হাওড়া, কেষ্টপুর, টালা-সহ প্রায় ১৫টি জায়গায় কেন্দ্রীয় বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান চালান কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা।
বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে রাত পর্যন্ত চলে তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব। সূত্রের দাবি, বেশকিছু নথিপত্রও নিয়ে গিয়েছে সিবিআই। সেগুলি খতিয়ে দেখে আবারও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হতে পারে।
সন্দীপের বাড়ির সামনে অপেক্ষায়
রবিবার সকালে ঘড়ির কাঁটায় তখন ৬টা ৫০ মিনিট। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নিয়ে বেলেঘাটায় সন্দীপ ঘোষের বাড়িতে হানা দেয় সিবিআই। তবে, বাইরে থেকে তদন্তকারীরা একাধিক বার তাঁর বাড়ির কলিং বেল বাজালেও খোলেনি দরজা। তখন সন্দীপের সঙ্গে বারবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে সিবিআই।
প্রায় সওয়া এক ঘণ্টা ধরে বাড়ির বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার অফিসারদের। অবশেষে সকাল ৮ নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন সন্দীপ। এরপর সিবিআইয়ের ৫ জন অফিসার ঢোকেন তাঁর বাড়িতে। এর আগে আরজি করে ধর্ষণ-খুনের মামলায় তাঁকে ন’দিন ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও সন্দীপের বাড়িতে তল্লাশি অভিযান এই প্রথম। দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ প্রক্রিয়া শেষে রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ সন্দীপের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন তদন্তকারীরা।
নজরে অন্য আধিকারিকরাও
নিজাম প্যালেস থেকে সিবিআইয়ের একটি টিম সকালে পৌঁছে যায় কেষ্টপুরে দেবাশিস সোমের বাড়িতে। তিনি আরজি করের ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগের শিক্ষক-চিকিৎসক। পাশাপাশি, এন্টালিতে আরজি করের প্রাক্তন সুপার সঞ্জয় বশিষ্ঠের বাড়িতেও যায় তদন্তাকারীদের অন্য একটি টিম। আরজি করের প্রাক্তন ডেপুটি সুপার আখতার আলি যে দুর্নীতির অভিযোগ করেছিলেন, তাতে সঞ্জয়, দেবাশিসদেরও নাম রয়েছে। বেলা আড়াইটে নাগাদ সঞ্জয়কে নিয়ে ট্যাংরার একটি ফ্ল্যাটে যান তদন্তকারীরা।
সিবিআই সূত্রে খবর, ওই ফ্ল্যাটটির রেজিস্ট্রেশন রয়েছে সঞ্জয়ের স্ত্রীর নামে। দু’টি জায়গাতেই বেশকিছু নথি খতিয়ে দেখেন তদন্তকারীরা। সিবিআই যেটা জানতে চাইছে, কতদিন ধরে এই দুর্নীতির কারবার চলছিল এবং ঠিক কী ভাবে মেডিক্যাল ওয়েস্ট, মর্গ থেকে দেহ পাচারের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
হাসপাতালে টেন্ডার পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কী নিয়ম রয়েছে এবং অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষদের কী ভূমিকা থাকে, তাও জানার চেষ্টা করছেন তদন্তকারীরা। বিকেল চারটে নাগাদ দেবাশিসকে তাঁর বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয় নিজাম প্যালেসে। সেখানে গভীর রাত পর্যন্ত তাঁর জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব চলেছে।
এঁদের বাইরেও এ দিন বেলগাছিয়ার জেকে ঘোষ রোড এবং টালায় দুই ব্যবসায়ীর বাড়িতেও যায় সিবিআই। হাসপাতালে বরাত সরবরাহের ক্ষেত্রে তাঁদের কোনও ভূমিকা ছিল কি না, দেখা হচ্ছে। সিবিআইয়ের কয়েকজন আধিকারিক আরজি করের অধ্যক্ষ ও সুপারের অফিসেও যান। কথা বলেন সেখানকার কর্মীদের সঙ্গে। সেই সঙ্গে প্রশাসনিক ভবন, ক্যান্টিনের কর্মীদের সঙ্গেও কথা বলেছেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার অফিসাররা।
ভুল ঠিকানায় সিবিআই
এ দিন অভিযানে নেমে খানিকটা ‘উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে’র মতো অবস্থায় পড়তে হয় তদন্তকারীদের। সিবিআইয়ের একটি দল এ দিন সকালে হাওড়ার সাঁকরাইলের হাটগাছার বাসিন্দা জনৈক মদন পাড়ুইয়ের বাড়িতে হাজির হয়। যা দেখে আকাশ থেকে পড়েন মদনবাবু। এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে তাঁর সঙ্গে কথা বলে এবং কিছু কাগজপত্র খতিয়ে দেখে আধিকারিকরা বুঝতে পারেন, ভুল ঠিকানায় এসে পৌঁছেছেন তাঁরা। অকারণে বিরক্ত করার জন্য তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতেও বাধ্য হন তদন্তকারীরা।
ব্যাপারটা কী? সূত্রের খবর, আরজি করের দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলার তদন্তে সাঁকরাইলের হাটগাছায় ‘মা তারা ট্রেডার্স’ নামে একটি সংস্থায় অভিযানে বেরিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। তবে প্রথমে খোঁজ নিয়ে তাঁরা ঢুকে পড়েন ‘মা তারা বিল্ডার্স’ নামে একটি সংস্থার মালিক মদন পাড়ুইয়ের বাড়িতে।
তাঁর ব্যবসার কাগজপত্র পরীক্ষা করে সিবিআই আধিকারিকরা বুঝতে পারেন, তিনি ওষুধ বা চিকিৎসার যন্ত্রপাতি সরবরাহের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত নন। সন্দীপ ঘোষকেও তিনি চেনেন না। পরে মদনের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে তাঁরা ‘মা তারা ট্রেডার্স’-এর উদ্দেশে রওনা হন। খোঁজ পান ওই সংস্থার কর্তা বিপ্লব সিংহের বাড়ির। তাঁকেও দীর্ঘক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রাত আটটা নাগাদ সিবিআইয়ের ৭ সদস্যের একটি দল সাঁকরাইলের হাটগাছা শিবতলায় ওষুধ ব্যবসায়ী সুমন হাজরার বাড়িতেও হানা দেয়।