এই সময়, শিলিগুড়ি: এটাকে আবিষ্কার না-বললেও কম কিছু নয়। সেই কবে মেঘালয়ের বাসিন্দা ও গবেষক ফুকেন উল্লেখ করে গিয়েছিলেন হিমালয়ান রেঞ্জের অর্কিড ‘পিওনি প্রিকক্স’ সাদা রঙেরও হয়। ভুটানের ফ্লোরা নিয়ে গবেষণার জন্য গোটা বিশ্বে যিনি বিখ্যাত, সেই ফিলিপ জে গ্রিবও কয়েকটি উদ্ভিদবিদ্যা সংক্রান্ত শব্দকোষে সাদা রঙের ‘পিওনি প্রিকক্স’-এর উল্লেখ করেছেন।কিন্তু কারও ভাঁড়ারেই সাদা রঙের ‘পিওনি প্রিকক্স’-এর কোনও ছবি ছিল না। বিজ্ঞানে ছবি ছাড়া কোনও আবিষ্কারেরই তেমন গুরুত্ব নেই। কিন্তু তাই বলে সেই সাদা রঙের ‘পিওনি প্রিকক্স’-এর সন্ধান মিলবে নেওড়ার জঙ্গলে! তাজ্জব ব্যাপার।
২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নেওড়ার জঙ্গলে সমীক্ষা করে বন দপ্তর। মূলত নেওড়ার অর্কিড, সাপ, কিছু বিরল উদ্ভিদ, প্রজাপতির খোঁজে পাঁচটি পর্যায়ের ওই সমীক্ষা হয়। ওই সময়েই নেওড়া বনাঞ্চলের ভোটেখারকায় অর্কিডটি চিহ্নিত করেন বর্তমানে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজের উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষক শুভদীপ মজুমদার ও সহযোগী গবেষকেরা। তার পরে শুরু হয় গবেষণা।
প্রথমে এটিকে আবিষ্কার ভাবা হলেও পরে দেখা যায় তেমন কিছু নয় বটে, তবে একেবারে হেলাফেলারও নয়। সাধারণত এ ধরনের অর্কিড গোলাপি রঙের হয়। তবে নেওড়াভ্যালি বনাঞ্চলে সাদা রংয়ের প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। ভারতে সাদা রঙের ‘পিওনি প্রিকক্স’-এর নমুনা কোথাও নেই। শুভদীপের এই গবেষণাটি গত ৩১ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয় উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের জার্নাল ‘প্লিঅনে’।
তার পরেই গবেষক মহলে হইচই পড়ে যায়। স্কটিশ চার্চ কলেজের ওই শিক্ষক বলেছেন, ‘সাদা রঙের ‘পিওনি প্রিকক্স’-এর নমুনার কথা আমাদের কাজের মাধ্যমেই প্রথম জানা গেল।’ হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন (ন্যাফ)-এর কোঅর্ডিনেটর অনিমেষ বসুর কথায়, ‘নেওড়া বনাঞ্চলকে কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রক কবে থেকেই তো ‘ভার্জিন ফরেস্ট’ বলে ঘোষণা করেছে। স্রেফ গবেষণার প্রয়োজন ছাড়া সেখানে প্রবেশ একেবারেই নিষেধ। নেওড়ার এমনও অনেক এলাকা রয়েছে, যেখানে বনকর্মীরাও প্রবেশ করেন না। ফলে নেওড়ার জঙ্গলে কী কী রয়েছে, সেটা এখনও বন দপ্তরেরও অজানা।’
শুভদীপদের কাজের গুরুত্ব কতটা সেটা অবশ্য টের পাওয়া যাবে সেন্ট্রাল ন্যাশনাল হার্বেরিয়ামে গেলেই। সেখানে শুভদীপদের সংগ্রহ করা ‘পিওনি প্রিকক্স’-এর তিনটি নমুনা ভবিষ্যতের গবেষকদের কথা ভেবে সংরক্ষিত করা হয়েছে। বন দপ্তরের উত্তরবঙ্গের অতিরিক্ত প্রধান মুখ্য বনপাল উজ্জ্বল ঘোষের উদ্যোগে যখন এই সমীক্ষা শুরু হয় তখন কারও ধারণাই ছিল না কী মিলতে পারে নেওড়ার গভীর জঙ্গল থেকে।
সব কিছু হারিয়ে যাওয়ার আগে নিজেদের সম্পদের একটি তালিকা তৈরি করতেই বন দপ্তর এই সমীক্ষায় নামে। মূলত উদ্ভিদিবদ্যা বিভাগের গবেষক, বনকর্মী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরাই ছিলেন সেই সমীক্ষায়। শুভদীপ মজুমদার তখন মালবাজারের পরিমল মিত্র কলেজের শিক্ষক। নতুন নতুন গাছের খোঁজে বার হয়ে পড়েন উত্তরবঙ্গের জঙ্গলে। ২০১৯ সালে ওই সমীক্ষায় ডাক পেয়েছিলেন শুভদীপও।
করোনার বিশ্বজোড়া সংক্রমণ এবং লকডাউনের জেরে সেই সমীক্ষা বার বার ব্যাহত হয়। শেষ তিনটি পর্যায়ে ছিলেন শুভদীপ। তার পরে ওই ‘আবিষ্কার’। গোলাপি নয়, ধবধবে সাদা পিওনি প্রিকক্স-এর একটি পাঁপড়িতে সামান্য হলুদ রঙের ছিটে। অর্কিডের মূল্য তার অনিন্দ্যসুন্দর সৌন্দর্যের জন্যই।
এক-একটি অর্কিড দীর্ঘজীবী হয়। ঘরে তিন মাস রেখে দিলেও ফুলের তাজা ভাব সহজে নষ্ট হতে চায় না। পিওনি প্রিকক্স ফুলের আয়ু অবশ্য বড়জোর দশ দিন। কিন্তু নেওড়ার জঙ্গলে সে-ই যেন রাজা।