• নেপথ্যে লাশের রাজনীতি, ভিডিয়ো দেখিয়ে দাবি জোড়াফুল-পুলিশের
    এই সময় | ২৭ আগস্ট ২০২৪
  • এই সময়: নামে অরাজনৈতিক হলেও আসলে কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি সুপরিকল্পিত ভাবে মঙ্গলবারের নবান্ন অভিযান ঘিরে অশান্তি পাকাতে চাইছে বলে গত ক’দিন ধরেই অভিযোগ করছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। এই অভিযানের নেপথ্যে ‘লাশের রাজনীতি’ রয়েছে কি না, কয়েকটি ভিডিয়ো দেখিয়ে সোমবার তৃণমূল এই প্রশ্নও তুলল। ‘পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র সমাজ’-এর ব্যানারে আজকের অভিযানে পুলিশের পোশাক পরে দুষ্কৃতীরা অশান্তি তৈরির পরিকল্পনা করছে বলে রবিবার অভিযোগ করেছিল জোড়াফুল।অশান্তি পাকাতে ভিন রাজ্য থেকে বাংলায় লোক ঢোকানো হচ্ছে বলেও দাবি করেছিল শাসক দল। নবান্ন অভিযানের নাম করে আদতে অশান্তি তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে সোমবার চারটি ভিডিয়ো প্রকাশ করে দাবি করলেন রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইন-শৃঙ্খলা) মনোজ ভার্মা এবং এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতিম সরকার। নবান্নে রাজ্য পুলিশের দুই শীর্ষ কর্তার সাংবাদিক বৈঠকের ঘণ্টা দুয়েক আগেই তৃণমূল ভবনে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, কুণাল ঘোষ ও জয়প্রকাশ মজুমদার দু’টি ভিডিয়ো প্রকাশ করে একই দাবি করেন।

    চন্দ্রিমার অভিযোগ, ‘লাশ ফেলে, বডি ফেলে এরা যে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছে, একটি ভিডিয়োতে সেটাই দেখা যাচ্ছে। কিছু দিন আগে বিরোধী দলনেতা নিজেই বলেছেন যে, ২৭ অগস্ট গুলি চলবে। এখন বোঝা যাচ্ছে, অরাজকতা তৈরি করা এদের মূল উদ্দেশ্য।’ তৃণমূল ভবনে যে দু’টি ভিডিয়ো দেখানো হয়, সেখানে যে ব্যক্তিদের কথোপকথন শোনা গিয়েছে, তাঁরা পশ্চিম মেদিনীপুরের বিজেপি নেতা বলে তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি। তাঁদের বক্তব্য, একটি ভিডিয়োতে চন্দ্রকোনার বিজেপি নেতা বিপ্লব মালকে দেখা গিয়েছে। অন্য ভিডিয়োয় সৌমেন চট্টোপাধ্যায় নামে আর একজন বিজেপি নেতা রয়েছেন।

    এছাড়া খড়ার পুরসভার বিজেপি কাউন্সিলার বাবলু গঙ্গোপাধ্যায়কেও দেখা গিয়েছে। যদিও ‘এই সময়’ এই ভিডিয়োগুলির কোনওটিরই সত্যতা যাচাই করেনি। কুণাল বলেন, ‘এই আলোচনা চলছে যে, ডেডবডি চাই। বলা হচ্ছে, ডেডবডি না হলে রাজনীতি করতে পারব না। অপশক্তির এই চক্রান্ত আমরা সফল হতে দেবো না। এরা শকুনের রাজনীতি করছে।’ যদিও বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের সাফ কথা, ‘বিজেপি মৃতদেহ নিয়ে রাজনীতি করে না। তৃণমূল নেতৃত্ব বাম জমানায় মৃতদেহ নিয়ে কত বার দৌড়াদৌড়ি করেছেন, তা সবাই দেখেছেন।’

    কয়েক দিন আগে ‘পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র সমাজ’ নামে একটি অনামী সংগঠনের ব্যানারে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের ঘটনার প্রতিবাদে নবান্ন অভিযানের ডাক দেওয়া হয়। প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক বৈঠকে করে যে তিন ‘ছাত্র’ এই নবান্ন অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন, তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে গত শুক্রবারই তৃণমূল প্রশ্ন তুলেছিল। এই যুবকরা সরাসরি বিজেপি-সহ গেরুয়া শিবিরে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত বলে তৃণমূল ও সিপিএম দাবি করেছে।

    এই প্রেক্ষাপটে ‘পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র সমাজ’-এর নামে যে ফেসবুক পেজ রয়েছে, তার স্ক্রিনশটের প্রিন্ট আউট দেখিয়ে সোমবার নবান্নে সুপ্রতিম বলেন, ‘যে সংগঠনের পক্ষ থেকে অভিযানের ডাক দেওয়া হয়েছে, সেই সংগঠনের ফেসবুক পেজে গেলে আপনারা দেখতে পাবেন, কারা এই পেজের ফলোয়ার।’ সুপ্রতিম নাম না-করলেও সেখানে এক বিজেপি নেতা ও গেরুয়াপন্থী ছাত্র সংগঠনের নাম রয়েছে।

    রাজ্যের শাসক দল ও প্রশাসনের প্রবল চাপের মুখে এ দিন বিকেলে কলকাতা প্রেস ক্লাবে ফের সাংবাদিক বৈঠক করে ‘পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র সমাজ’-এর তরফে শুভঙ্কর হালদার, প্রবীর দাস ও সায়ন লাহিড়ি দাবি করেন, এই নবান্ন অভিযানের ডাক তাঁরা দেননি। সোশ্যাল মিডিয়ায় সাধারণ মানুষ এই নবান্ন অভিযানের ডাক দিয়েছেন। যদিও শুক্রবার এই তিন জনই প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক বৈঠক করে ২৭ তারিখ নবান্ন অভিযান হবে বলে ঘোষণা করেছিলেন।

    এই কয়েক দিনে ‘পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র সমাজ’ নবান্ন অভিযানের প্রশাসনিক অনুমতি নেয়নি বলে দাবি করেন সুপ্রতিমরা। পুলিশকর্তাদের দাবি, এই নবান্ন অভিযানকে অরাজনৈতিক বলে দেখানো হলেও এই অভিযানের নেপথ্যে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা শহরের একটি নামী হোটেলে এক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

    সুপ্রতিমের কথায়, ‘আমাদের কাছে খবর রয়েছে, যাঁরা নবান্ন অভিযানের ডাক দিয়েছেন, তাঁদের এক জন রবিবারই কলকাতার এক পাঁচতারা হোটেলে এক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে দেখা করেছেন। তদন্তের স্বার্থেই আমরা এর বেশি কিছু বলতে পারছি না। এই বিষয়ে আমরা আরও তথ্য সংগ্রহ করছি। সেই তথ্য যথা সময়ে আমরা আদালতে জমা দেবো।’

    সুপ্রতিম নির্দিষ্ট ভাবে কোনও রাজনৈতিক নেতার নাম না করলেও গেরুয়া শিবিরের দিকে ইঙ্গিত রয়েছে বলে বিজেপি নেতাদের পর্যবেক্ষণ। যদিও এই অভিযোগ স্রেফ প্রোপাগান্ডা বলে বিজেপির দাবি। এ দিন সুপ্রতিম আরও বলেন, ‘এই নবান্ন অভিযানে মহিলা এবং ছাত্রদের সামনে রেখে পিছন থেকে অশান্তির পরিস্থিতি তৈরি করা হতে পারে বলে আমরা খবর পেয়েছি। পুলিশকে বলপ্রয়োগে উস্কানি দিতেই এটা করা হবে।’

    নবান্ন ও তৃণমূল যে ভিডিয়ো দেখিয়ে চক্রান্তের অভিযোগ করেছে, সেই ভিডিয়োর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সুকান্ত। তিনি বলেন, ‘এই ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করা দরকার। এই ভিডিয়োর বিরুদ্ধে আইনি লড়াই লড়ব। এটা বিকৃত ভিডিয়ো। ছাত্রদের ভয় দেখানোর জন্য তৈরি করা হয়েছে। রাজ্যে কোনও আন্দোলন হলেই দেখা যায়, পুলিশ কোনও ভিডিয়ো নিয়ে হাজির হচ্ছে। একে ভিডিয়ো-অন-ডিমান্ড বলা যেতে পারে।’ এই নবান্ন অভিযানের সঙ্গে বিজেপি কোনও ভাবেই যুক্ত নয় বলে আবারও দাবি করেন সুকান্ত। তবে এই নবান্ন অভিযানের প্রতি তাঁদের নৈতিক সমর্থন রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

    এডিজি (আইন-শৃঙ্খলা) মনোজ ভার্মাকে নিশানা করে সুকান্তর বক্তব্য, ‘এডিজি-র দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, সাংবাদিক সম্মেলন করা ওঁর কাজ নয়। তবে অতীতে আন্দোলন ভাঙতে সিভিক পুলিশকে দিয়ে লাঠি চালানো হয়েছে। এবারেও সেই পরিকল্পনা করা হয়েছে কি না, জানি না। উত্তরবঙ্গের তৃণমূলের এক নেতা নিজেই লাঠি নিয়ে আসছেন বলে আমাদের কাছে ছবি আছে। তাই কিছু ভিডিয়ো দেখিয়ে বিজেপির ঘাড়ে আগাম দায় চাপানো হচ্ছে।’

    গেরুয়া শিবির নবান্ন ও তৃণমূলের দেখানো ভিডিয়োর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও এই ভিডিয়োর ভিত্তিতেই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশ বিজেপির দুই নেতা সৌমেন চট্টোপাধ্যায় ও বাবলু গঙ্গোপাধ্যায়কে এ দিন আটক করেছে। জেলার পুলিশ সুপার ধৃতিমান সরকার সন্ধেয় বলেন, ‘দু’জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় ডেকেছি। জিজ্ঞাসাবাদ করাও হয়েছে। এখনও জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। জিজ্ঞাসাবাদে ভিডিয়োর সত্যতা স্বীকার করেছে। এই ঘটনায় চন্দ্রকোনার আরও একজনকে ডেকে পাঠানো হয়েছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। এই ঘটনায় আরও কারা জড়িত, মাথা কারা, কী পরিকল্পনা ছিল— সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
  • Link to this news (এই সময়)