যে ‘চাপে’ স্বাস্থ্য অধিকর্তার জারি করা সাসপেনশনের নোটিস এক রাতে প্রত্যাহার হয়, এক পড়ুয়াকে মেডিক্যাল কলেজের পরীক্ষার পর্যবেক্ষক করে দেওয়া হয়, রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তাকে নিজের পদাধিকার বলে নয়; মেডিক্যাল কাউন্সিলের প্রতিনিধি হিসাবে মেডিক্যাল কলেজ পরিদর্শনে যেতে বাধ্য করা হয়, স্বাস্থ্য-প্রশাসনের অন্দরে সে ‘চাপের’ নাম ‘উত্তরবঙ্গ লবি’। সূত্রের দাবি, গত দশ বছরে স্বাস্থ্য-প্রশাসনে এই ‘লবি’ ক্রমশ জাঁকিয়ে বসেছে।
তখন বছর দু’য়েক হবে রাজ্যে সরকার বদলেছে। জলপাইগুড়িতে পরিদর্শনে এসে কাজে অনুপস্থিত থাকায়, ২০ জন সরকারি চিকিৎসককে এক সঙ্গে সাসপেন্ড করেন তৎকালীন স্বাস্থ্য অধিকর্তা। শাস্তিপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের তালিকায় ছিলেন বর্তমানে ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র ‘মেজো-কর্তা’ হিসাবে পরিচিত এক চিকিৎসকও। ঘটনাচক্রে, সে সময় উত্তরবঙ্গ সফরে ছিলেন রাজ্য সরকারের শীর্ষ কর্তারা। চিকিৎসকদের সাসপেন্ড হওয়ার খবর তুলে দেওয়া হয় তাঁদের কানে। সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিকর্তার নির্দেশ প্রত্যাহৃত হয়। ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র ‘জয়যাত্রা’ শুরু সেখান থেকেই। এই ‘লবি’র অন্যতম মুখ বলে পরিচিত জলপাইগুড়ির অবসরপ্রাপ্ত চোখের চিকিৎসক সুশান্ত রায়। যিনি করোনা-কালে উত্তরবঙ্গের ‘ওএসডি’ (জনস্বাস্থ্য) পদে বসেন এবং অবসরের পরেও চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধিতে সে পদেই ছিলেন।
রাজ্যের স্বাস্থ্য-প্রশাসনের নিয়ন্ত্রক ‘লবি’র নামে উত্তরবঙ্গ জড়াল কী ভাবে? এই ‘লবি’র মূল কর্তা বলে পরিচিত রাজ্যের এক শীর্ষ কর্তার ঘনিষ্ঠ এক বর্ষীয়ান চিকিৎসক। যিনি সরকারি পদে ছিলেন না। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। রাজ্যে পট পরিবর্তনের পরে, জলপাইগুড়ির সুশান্ত রায় সে সময়ে উত্তরবঙ্গে সিপিএমের এক মন্ত্রীকে হারিয়ে বিধায়ক হওয়া আর এক চিকিৎসকের ‘ঘনিষ্ঠ’ ছিলেন। বছর খানেকের মধ্যে সে বিধায়ককে ছেড়ে সুশান্ত রায় যোগ দেন তৃণমূলের এক চিকিৎসক-নেতার ‘ঘনিষ্ঠ-বৃত্তে’। কিছুদিনের মধ্যেই সে শিবির ছেড়ে বেরিয়ে আসেন সুশান্ত এবং তাঁর তত্ত্বাবধানে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের পুনর্মিলন উৎসবে রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তার ‘কাছের লোক’ বলে পরিচিত উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের প্রাক্তনী ওই বর্ষীয়ান চিকিৎসককে সম্মাননা দেওয়া হয়।
সেখান থেকেই সুশান্তের সঙ্গে ওই প্রবীণ চিকিৎসকের সুসম্পর্ক ‘অন্য মাত্রা’ পায়। তাঁদের ঘনিষ্ঠ চিকিৎসকেরাই পর-পর স্বাস্থ্য-প্রশাসনের পদ পেতে থাকেন। এই প্রভাব-বৃত্তে থাকা চিকিৎসকেরা হয়, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তনী না হয় ‘লবি’র দুই কর্তার ‘পছন্দের’।
সে সুবাদেই এই ক্ষমতার ভরকেন্দ্র পরিচিত হয়ে যায় ‘উত্তরবঙ্গ লবি’ নামে। করোনা-আবহে চক্ষু বিশেষজ্ঞ সুশান্ত গোটা উত্তরবঙ্গের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব পান। সুশান্তের ছেলে সৌত্রিক রায় উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে স্নাতকোত্তর (এমডি) পড়াকালীন জলপাইগুড়িতে থ্যালাসেমিয়া ইউনিটের দায়িত্বে ছিলেন। এমডি পড়ার বৃত্তি (স্টাইপেন্ড) এবং থ্যালাসেমিয়া ইউনিটের দায়িত্বে থেকে বেতনও তিনি পেতেন বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের দাবি। তা নিয়ে জেলার এক স্বাস্থ্য-কর্তা পরে তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার পরে, বদলি হয়ে যান। তা ছাড়া, এমডি পড়াকালীন কোনও চিকিৎসকের সরকারি দায়িত্বে থাকা নিয়ম অনুযায়ী সম্ভব নয়। সৌত্রিককে এ ব্যাপারে ফোন করা হলে ধরেননি। জবাব মেলেনি বার্তার।
স্বাস্থ্য প্রশাসনে চালু কথা, ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র আশীর্বাদ থাকলে এক পড়ুয়াও রাতারাতি মেডিক্যাল কলেজের পরীক্ষার তদারকির দায়িত্ব পেয়ে যেতে পারেন। সূত্রের দাবি, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের এমডি-তে পড়াশোনা করা এক ডাক্তারি পড়ুয়াকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের পরীক্ষার পর্যবেক্ষক করা হয় শুধু ‘উত্তরবঙ্গ লবির লোক’ বলেই।
ছেলেকে নিয়ে এ সব অভিযোগ উঠলে আগে সুশান্ত রায় বলতেন, ‘‘ভিত্তিহীন কথা।’’ এ দিন সুশান্তকে ফোন করা হলে মোবাইল বেজে গিয়েছে। মেসেজ করা হলে উত্তর মেলেনি।
জলপাইগুড়ি মেডিক্যাল কলেজ পরিদর্শনে গত জুন মাসে এসেছিলেন স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা কৌস্তভ নায়েক। যদিও সেই পরিদর্শন স্বাস্থ্য-শিক্ষা দফতরের না পশ্চিমবঙ্গ মেডিক্যাল কাউন্সিলের তরফে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কারণ, কাউন্সিলের কর্তাদের ‘টিম’ গড়ে তা করা হয়। চিকিৎসকদের একাংশ প্রশ্ন তোলেন, মেডিক্যাল কাউন্সিলের তেমন পরিদর্শনের এক্তিয়ার রয়েছে কি না। চিকিৎসকদের একাংশের দাবি, সুশান্ত এখন মেডিক্যাল কাউন্সিলের সহ-সভাপতি এবং তাঁর ছেলে মেডিক্যাল কাউন্সিলের শাস্তি এবং নীতি কমিটির সদস্য।
আর জি কর-কাণ্ডের পরে, ৪৩ জন চিকিৎসককে বদলির যে নির্দেশ হয়েছিল, যা পরে বাতিল হয়, তার নেপথ্যেও ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র হাত ছিল বলে সূত্রের খবর। ‘প্রভাবশালী’ ওই চিকিৎসকদের স্বাস্থ্য-প্রশাসনে এতটাই ‘দাপট’ বলে দাবি সরকারি চিকিৎসকদের একাংশের।