প্ররোচনা সত্ত্বেও ফাঁদে পা দেয়নি পুলিশ, দাবি নবান্নের
এই সময় | ২৮ আগস্ট ২০২৪
এই সময়: 'পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র সমাজ'-এর আহ্বানে নবান্ন অভিযানে যাতে গুলি না চলে, তার জন্য গত ২০ অগস্ট রাজ্য সরকারের উদ্দেশে সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। এই অভিযান যে জঙ্গি আন্দোলনের চেহারা নিতে পারে, সেই আভাস বিধানসভার বিরোধী দলনেতা কথাতেই ছিল বলে দাবি তৃণমূলের। শুভেন্দুর এই হুঁশিয়ারিকে অস্ত্র করেই নবান্ন অভিযানের ভিড়ে দুষ্কৃতীরা মিশে গিয়ে গোলমাল পাকাতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল তৃণমূল।তবে মঙ্গলবার শেষমেশ হাওড়ার সাঁতরাগাছি, ফোরশোর রোড, কলকাতায় হেস্টিংস, মহাত্মা গান্ধী রোড, ধর্মতলা, শিয়ালদহ-সহ একাধিক জায়গায় নবান্ন অভিযানের নামে বিক্ষোভ, অবরোধ, ভাঙচুর হলেও পুলিশ সংযমের সঙ্গে তা সামাল দিয়েছে বলে মনে করছে নবান্ন। জল কামান, কাঁদানে গ্যাসের সঙ্গে কিছু জায়গায় বিক্ষিপ্ত লাঠিচার্জ করা হলেও পুলিশ কোনও জায়গায় গুলি চালায়নি।
এমনকী একাধিক জায়গায় পুলিশকে মারধর, পুলিশের মোটরবাইকে অগ্নিসংযোগ, গাড়ি ভাঙচুর করা হলেও পরিস্থিতি কখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি বলেও দাবি রাজ্য প্রশাসনের। তাই এ দিন এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতিম সরকার বলেন, 'সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ কোনও হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু আন্দোলন কতটা শান্তিপূর্ণ থাকল, সেটা দেখলেন সবাই। আন্দোলনকারীরা এলেন, ব্যারিকেড ধরে ঝাঁকানো হলো, ব্যারিকেড ভাঙা হলো! বোতল, ইট ছোড়া হলো পুলিশের দিকে। সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর করা হলো। গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হলো।'
কলকাতা পুলিশের ডিসি (সেন্ট্রাল) ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, 'সকাল ৮টা থেকে রাস্তায় ছিলাম। ১১টা নাগাদ ইটবৃষ্টি শুরু করে দুষ্কৃতীরা। পুলিশকে প্ররোচনা দেওয়া হয়।' 'পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র সমাজ'-এর আহ্বানে এই নবান্ন অভিযানে অশান্তি এড়াতে এ দিন সকাল থেকেই হাওড়ার একাধিক জায়গায় পুলিশি বন্দোবস্ত খতিয়ে দেখেন রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার।
সাঁতরাগাছি, ফোরশোর রোড, মন্দিরতলায় মোতায়েন থাকা পুলিশকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। এই ধরনের আন্দোলনের মোকাবিলায় কাঁদানে গ্যাস, জল কামান, রোবো-কপের সঙ্গে রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরির জন্য হাওড়ার সাঁতরাগাছি-সহ কয়েকটি জায়গায় খালি কন্টেনার নামিয়ে দেয় পুলিশ। প্রবীণ পুলিশকর্তাদের একাংশের বক্তব্য, স্টিলের ব্যারিকেড থাকলেও তা আন্দোলনকারীদের চাপে উপড়ে পড়তে পারে, এই আশঙ্কা থেকেই কন্টেনার রাখা হয়েছিল।
হাওড়া ও কলকাতার অধিকাংশ পয়েন্টে নবান্নমুখী মিছিল ব্যারিকেডে আটকে গেলেও মূল মিছিলগুলির পাশাপাশি অঘোষিত রুট দিয়েও একাধিক ছোট মিছিল বের করেন আন্দোলনকারীরা। এমনই একটি মিছিল এ দিন নবান্নের নাকের ডগায় চলে আসে। হাওড়ার চ্যাটার্জিহাটে অবরোধকারীদের জমায়েত হয়েছিল। তাদের হাতে ছিল জাতীয় পতাকা আর 'বিচার চাই' লেখা পোস্টার।
আচমকাই বেলা আড়াইটে নাগাদ জমায়েতকারীরা শরৎ চ্যাটার্জি রোড ধরে নবান্নের দিকে এগোতে থাকেন স্লোগান দিতে দিতে। পুলিশ, র্যাফ, উইনার্স বাহিনী, কমব্যাট ফোর্স ছুটে যায় মিছিল আটকাতে। যদিও বিকেল তিনটে নাগাদ মিছিল নবান্নর কাছে চলে আসে। সেখানে পুলিশকে এক রাউন্ড কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে হয়। সেখান থেকে পুলিশ তিন জনকে মিছিল থেকে গ্রেপ্তার করে।
এঁদের মধ্যে ধৃত সুশ্রী দাস জানান, তিনি কোনও কলেজের ছাত্রী নন। কোনও ছাত্র সগঠনের সঙ্গেও তাঁর যোগ নেই। বিবেকের তাড়নায় তিনি এই প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। ধৃত আরও একজন, লিলুয়ার কমলেশ ভার্মা দাবি করেন, তিনি আইনের ছাত্র। কিন্তু কোন কলেজের, তা বলতে পারেনি।
শুধু শরৎ চ্যাটার্জি রোড নয়, নবান্নের অন্য পাশে হরিদেব ভট্টাচার্য লেনে সকাল থেকেই দু'দফায় দু'টি দল নবান্নের কাছে এসে বিক্ষোভ দেখায়। এই বিক্ষোভস্থল থেকে নবান্নর মূল ফটকের দূরত্ব ২০ মিটারও নয়। যদিও এই দু'দফায় বিক্ষোভে পুলিশ কাউকে আটক অথবা গ্রেপ্তার করেনি। এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই পৌঁছে যান নবান্নে। কিন্তু নবান্নের কাছাকাছি যে বিক্ষোভকারীরা পৌঁছে গিয়েছিলেন, তাঁদের দিকে পুলিশ দৌড়ে গেলেও বেপরোয়া লাঠিচার্জ হয়নি।
পুলিশের এই সার্বিক ভূমিকা নিয়ে নবান্নে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, 'ছাত্র সমাজের নামে প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে। গুন্ডা আমদানি করা হয়েছে। চণ্ডীতলার আইসি-সহ পুলিশকে অনেক জায়গায় আক্রমণ করা হয়েছে। ইট ছুড়ে, কোথাও লাঠি মেরে হামলা চালানো হয়েছে। কিন্তু পুলিশ ধৈর্য হারায়নি। ওদের (আন্দোলনকারী) চাহিদা ছিল লাশ। সেটা এ দিন হলো না। পুলিশ ওদের প্ররোচনায় পা দেয়নি।'
চন্দ্রিমা, ব্রাত্য বসু-সহ রাজ্যের মন্ত্রীরা পুলিশের প্রশংসা করলেও পাল্টা তোপ দেগেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তিনি বলেন, 'সোমবার মধ্যরাত থেকে রাজ্যজুড়ে পুলিশ গ্রেপ্তারি শুরু করেছিল। যে চার জন এই ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন তাঁদেরও হাওড়া কমিশনারেট রাতে গ্রেপ্তার করে। সিভিকদের পুলিশের পোশাক পরিয়ে আনা হয়েছিল। এছাড়া প্রায় ১৩-১৪ হাজার পুলিশ নামানো হয়েছিল। এত পুলিশ, কাঁদানে গ্যাস, জল কামান, লাঠি সত্ত্বেও নবান্নর সামনে গিয়ে মানুষ বলে এসেছে- দফা এক, দাবি এক, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ।'
কী ভাবে আন্দোলনকারীদের একাংশ নবান্নর এত কাছে পৌঁছে গেল, তা নিয়ে প্রশাসনের মধ্যেও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কারণ, কঠোর নিরাপত্তায় গোটা নবান্ন তল্লাট মুড়ে ফেলা হয়েছিল। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল নবান্ন বাস স্ট্যান্ড। যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল লাগোয়া মন্দিরতলায়। লোহার ব্যারিকেড দিয়ে ঘেরাটোপ তৈরি করা হয়।
পরিচয়পত্র ছাড়া সাধারণ মানুষের হেঁটে যাওয়ার অনুমতিও ছিল না। নবান্নে কর্মরত সরকারি কর্মীদের নিয়ে আসা সরকারি বাসকেও টোল ট্যাক্সের সামনে ব্রিজের উপরই দাঁড় কিয়ে দেওয়া হয়। ফলে অফিসযাত্রীরা বৃষ্টির মধ্যেই ভিজে নবান্নে ঢোকেন। দ্বিতীয় হুগলি সেতু দিয়ে বেসরকারি বাস চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বাইক, স্কুটারে যে সব সরকারি কর্মচারী এসেছিলেন নবান্নে, তাঁদেরও গাড়ি থামিয়ে পরিচয়পত্র পরীক্ষা করেছে পুলিশ।
তবে আন্দোলকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘাতে উত্তপ্ত হয়েছে কলকাতার বাবুঘাট, হাওড়ার বঙ্গবাসী, ফোরশোর রোড এবং গ্র্যান্ড ফোরশোর রোডের সংযোগস্থল। হাওড়া ময়দানে বঙ্গবাসী সিনেমা হল ভেঙে যে নতুন শপিং মল তৈরি হয়েছে, সেখানেই একটি পুরোনো ইটের দেওয়াল থেকে ইট খুলে আন্দোলনকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ছুড়েছে বলে অভিযোগ। যদিও আন্দোলনকারীদের দাবি, পুলিশই প্রথমে বাড়ির ছাদ থেকে ইট ছুড়তে থাকে।
এ দিন রাতে কলকাতা পুলিশ বাবুঘাটের হামলাকারী বলে একদলের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছে। এই অশান্তির ঘটনাগুলির প্রসঙ্গ তুলে নবান্নে সুপ্রতিম বলেন, 'কর্মব্যস্ত একটি দিনে এমন পরিস্তিতি তৈরির চেষ্টা হয়, যাতে সাধারণ মানুষের কোনও ক্ষতি হয়, পুলিশ যাতে প্ররোচনায় পা দেয়। এর নিন্দার ভাষা আমাদের নেই।'