• কোভিড-পর্বের নানা ‘অনিয়মে’ প্রশ্নে ভূমিকা
    আনন্দবাজার | ২৮ আগস্ট ২০২৪
  • কোভিডের সময় বাড়বাড়ন্ত ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র। সে সময় ডাক্তার এবং রোগীদের খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা, চিকিৎসকদের রাখার জন্য কয়েক কোটি টাকার হোটেলের খরচা, ‘পিপিই কিট’, মাস্ক তৈরি তথা কেনার খরচা হয়েছে। অথচ, অনেক ক্ষেত্রেই বিল এখনও বকেয়া বলে অভিযোগ। সে পর্বেই প্রশাসনের বাছাই করা নার্সিংহোমের বদলে আলাদা করে হাসপাতাল তৈরিতে খরচ করা হয়েছে। পরিকাঠামো তৈরিতে ‘অনাবশ্যক’ খরচ এবং আর্থিক নয়ছয় বা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল প্রশাসনের অন্দরে। কিন্তু সে সময়ে উত্তরবঙ্গের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ‘ওএসডি’ (জনস্বাস্থ্য) সুশান্ত রায় সব অভিযোগই ‘ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেছেন। রাজ্য স্বাস্থ্য-প্রশাসনের অন্দরে ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র অন্যতম কর্তা বলে পরিচিত জলপাইগুড়ি জেলা সদর হাসপাতালের এই প্রাক্তন চোখের চিকিৎসক।

    করোনা-পরিস্থিতিতে উত্তরবঙ্গে স্বাস্থ্য দফতরের সামনের সারিতে ছিলেন সুশান্ত। সে সময় থেকেই তাঁর এবং ‘লবি’র বিরুদ্ধে নানা অনৈতিক কাজকর্মের অভিযোগ উঠতে থাকে। কোভিডের সময় ডাক্তারদের রাখতে স্বাস্থ্য দফতরের তরফে বিভিন্ন হোটেলে ঘর নেওয়া হয়েছিল। শিলিগুড়ি জংশন এলাকার এক হোটেল-মালিকের দাবি, তাঁর সঙ্গে স্বাস্থ্য দফতরের এক বছর হোটেল নেওয়ার চুক্তি হয়েছিল দুই কোটি টাকারও বেশিতে। এখনও তিনি দেড় কোটি টাকার বেশি পান। শিবমন্দিরের একটি হোটেল ‘পাবে’ আড়াই কোটি টাকার বেশি। এমন একাধিক হোটেল রয়েছে শিলিগুড়িতে।

    কোভিড-পর্বে শিলিগুড়ির সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক থেকে শুরু করে, রোগীদের খাবার সরবরাহের বরাত পেয়েছিলেন স্থানীয় একটি সংস্থা। সংস্থার মালিকের ক্ষোভ, সরকারি টেন্ডারে বরাত দেওয়া হয়েছিল। এখনও বকেয়া সাড়ে তিন কোটি টাকারও বেশি। বিল মেটানোর জন্য তাগাদা দিতে কলকাতায় গেলে, তাঁর কাছে ‘কাটমানি’ চাওয়া হয়েছে। যাঁরা তা চেয়েছেন, তাঁরা ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র ঘনিষ্ঠ বলে দাবি। নিরুপায় হয়ে তিনি মামলা করেছেন।

    স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, উত্তরবঙ্গের অন্য জেলায় খাবার সরবরাহের জন্য টেন্ডার ডাকা হয়েছিল। কিন্তু ‘লবির’ কর্তাদের সঙ্গে ‘রফা’ হলেই তা মিলবে বলে ঠিকাদারদের একাংশকে জানানো হয়। পরে, সে টেন্ডার-প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করিয়ে তা বন্ধ করে, ‘পছন্দের লোককে’ দিয়ে কাজ করানো হয় বলে অভিযোগ।

    স্বাস্থ্য দফতরের আর এক সূত্রে জানা গিয়েছে, কোভিডের সময় বর্ধিত হারে ‘পিপিই কিট’, মাস্কের দাম দেওয়া হয়েছে। সে সব প্রয়োজনের ‘অতিরিক্ত’ তৈরি করা হয়েছে। পরে, তা নষ্টও করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। নানা ‘দুর্নীতির’ একাংশ নিয়ে ইডি-র কাছে অভিযোগ করা হয়েছিল। সে তদন্ত খুব বেশি এগোয়নি। এগোলে, ‘উত্তরবঙ্গ লবি’ বিপদে পড়তে পারে বলে দাবি সূত্রটির।

    জলপাইগুড়িতে কোভিড হাসপাতাল তৈরির মুহূর্ত থেকে ‘উত্তরবঙ্গ লবি’ প্রভাব খাটায় বলে অভিযোগ। সমস্যা কোথায় হাসপাতাল হবে, তা নিয়ে। জেলা প্রশাসন জলপাইগুড়ির একটি নার্সিংহোমকে কোভিড-হাসপাতাল হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। অভিযোগ, সে সময় সুশান্ত রায়ের হস্তক্ষেপে জলপাইগুড়ির স্পোর্টস কমপ্লেক্স স্টেডিয়ামে কোভিড হাসপাতাল তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। কয়েক কোটি টাকা খরচ করে কেন পরিকাঠামো তৈরি হবে, কেন হাসপাতালের অপেক্ষায় বসে থাকা হবে, সে প্রশ্ন তোলেন চিকিৎসকদের একাংশ এবং জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসনের তৎকালীন আধিকারিকদের একাংশ। যদিও ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র প্রভাবে সব প্রশ্ন ‘ধামাচাপা’ পড়ে যায়।

    কোভিড হাসপাতালে অক্সিজেনের পাইপ বসানোর কাজ করেছিল একটি সংস্থা। বিল এখনও বকেয়া বলে তারা স্বাস্থ্য দফতরে আবেদন করেছে। পুরনো ফাইল বার করে দেখা গিয়েছে, যে সংস্থা কাজ করেছিল, তাদের টেন্ডার-প্রক্রিয়া, কাজ শুরুর নির্দেশের নথি যথাযথ নেই। তাই পাওনা মেটাতে সমস্যা হচ্ছে। যদিও প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে হাসপাতাল তৈরির জন্য আসা কোটি কোটি টাকা কোথায় খরচ হল! একাধিক বিল কেন মেটানো হল না? যথাযথ নথি ছাড়া, কী করে কাজ করানো হল?

    স্বাস্থ্য দফতরের একাধিক চিকিৎসকের কথায়, “যত দিন উত্তরবঙ্গ লবি সক্রিয় থাকবে, তত দিন এ সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে না।”
  • Link to this news (আনন্দবাজার)