এই সময়, কৃষ্ণনগর: ফের নবদ্বীপ নাট্যোৎসবে বন্ধ হলো একটি নাটকের মঞ্চায়ন। উৎপল দত্তের ‘ব্যারিকেড’-এর পরে এ বার চন্দন সেনের ‘চৈতন্য বিমঙ্গল’।নবদ্বীপে চলতে থাকা নাট্যোৎসবে বুধবার কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় নাট্যকার চন্দন সেনের ‘চৈতন্য বিমঙ্গল’ নাটকটি মঞ্চস্থ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নাটকের কাহিনীতে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে বলে দাবি তুলে নবদ্বীপ পুরসভা ও নবদ্বীপ থানায় অভিযোগ জানায় নবদ্বীপের গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজ। তারই জেরে এই সিদ্ধান্ত বলে মনে করা হচ্ছে।
নাটক বন্ধের কথা স্বীকার না করলেও নবদ্বীপের তৃণমূল পুরবোর্ডের প্রধান বিমানকৃষ্ণ সাহা বলেন, ‘ওই নাটকে চৈতন্যদেবের পারিবারিক জীবনের কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে বিকৃতির অভিযোগ পেয়েছি। ধর্মীয় স্পর্শকাতর জায়গায় আঘাত করা হয়েছে বলে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। আমরা বৈষ্ণব সমাজের সেই বার্তা নাট্যমেলার আয়োজকদের কাছে আগাম পৌঁছে দিয়েছি, যাতে নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার সময়ে কোনও বিশৃঙ্খলা না হয়। এই নাটক মঞ্চস্থ করলে শহরের শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে, সে বার্তাই আয়োজক সংস্থার কাছে পৌঁছে দিয়েছি।’
অন্য দিকে, নাট্যমেলার আয়োজক সায়ক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সম্পাদক মোহন রায় বলেন, ‘এই নাটক মঞ্চস্থ করা যাবে না, কার্যত এ রকম বার্তা আসায় আমরা বাধ্য হয়েছি এই নাটকের শো বন্ধ করতে।’
এর আগে গত ২৩ জানুয়ারি এই নবদ্বীপেই বন্ধ করা হয়েছিল দেবেশ চট্টোপাধ্যায় নির্দেশিত চাকদহ নাট্যজন প্রযোজিত উৎপল দত্তের ‘ব্যারিকেড’ নাটকের শো। এ বার নবদ্বীপ পুলিশের কাছ থেকে নাটক বন্ধ করার কোনও নির্দেশ আসেনি ঠিকই, তবে পুর কর্তৃপক্ষ ও বৈষ্ণব সমাজের তীব্র আপত্তির কথা জেনে শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান মোহন।
নবদ্বীপ গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের মহাসচিব কিশোরকৃষ্ণ গোস্বামী বলেন, ‘আমরা নাট্যোৎসবের বিপক্ষে নই। আবার কোনও নাটকের মঞ্চায়ন বন্ধ করারও কেউ নই। তবে নবদ্বীপে ‘চৈতন্য বিমঙ্গল’ নামে যে নাটকটি বুধবার মঞ্চস্থ হওয়ার কথা ছিল, সেই নাটকের কাহিনীতে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে বলে আমরা জেনেছি। তাই আমরা আমাদের প্রতিবাদ জানিয়েছি।’
কিন্তু বিতর্ক ঠিক কী নিয়ে? কী সেই বিকৃতি?
কিশোরকৃষ্ণ বলেন, ‘আয়োজক সংস্থার এক প্রতিনিধির কাছে জানতে পেরেছি যে, নাটকে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। মহাপ্রভুপত্নী লক্ষ্মীপ্রিয়াদেবীকে বিষ দান করে হত্যা করা হয়েছে বলে নাটকের কাহিনীতে উল্লেখ করা হয়েছে। আর চাঁদ কাজির সহায়তায় মহাপ্রভুর মাতা শচীদেবী সে কাজ করেছেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। চৈতন্য বিষয়ক কোনও প্রামাণ্য গ্রন্থে এ রকম গল্প লেখা হয়নি। মহাপুরুষের জীবনের ইতিহাস বিকৃত করা অতি গর্হিত কাজ। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের ভাবাবেগেও তীব্র আঘাত করবে এই বক্তব্য। তাই এই নাটকের প্রদর্শনে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম।’
নাট্যকার চন্দন সেনকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘চৈতন্যদেবের জীবনের একটা অধ্যায় নিয়ে নাটকটা। জীবনী এক জিনিস আর জীবনের একটা অংশ নিয়ে নাটক আরও এক জিনিস। থিয়েটারের একটা স্বাধীনতা আছে। কারও জীবন নিয়ে নাটক নির্মাণ করতে গেলে থিয়েটারের এই যে স্বাধীনতা, আমি তো সেই আশ্রয় নেবই। আর বৈষ্ণব সমাজ তো অনেক বড়। সারা দুনিয়া জুড়ে তাঁরা ছড়িয়ে আছেন। হাতে গোনা কয়েক জন মানুষ সেই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না। যাঁরা বিরোধিতা করছেন, তাঁরা কিন্তু বলছেন, তাঁরা শুনেছেন, দেখেননি।’
চাকদহ নাট্যজনের সম্পাদক সুমন পাল বলেন, ‘৪৮টি নাট্যদলের সদস্যদের মধ্যে থেকে কয়েক জনকে একত্রিত করে নতুন দল গড়ে এই নাটক নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু নবদ্বীপ পুরসভা কর্তৃপক্ষ নাটকের শো বন্ধ করে দিয়েছেন। এ ভাবে নাটক বন্ধ করা যায় না। নাটক দেখার পরে আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক হতেই পারত।’ একই শহরে বারবার কেন নাটকের শো বন্ধ করা হচ্ছে, সে প্রশ্ন তোলেন সুমন। পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘নাটকের শো বন্ধ করতে ধর্মীয় মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে। আমরা মাথা নত করব না।’