এই সময়: কেউ বলছেন, তিনি আপাদমস্তক এক জন নারীবিদ্বেষী। আবার কারও মতে, তিনিই প্রতিবাদের মুখ, প্রতিরোধের প্রতিনিধি। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটা ইস্তক গত ২০ দিন ধরে অসংখ্য মিছিল-মিটিং দেখছে শহর। তবে ‘পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র সমাজের’ ডাকা মঙ্গলবারের নবান্ন অভিযানে পুলিশের জলকামানের সামনে রক্তজবা বসনধারী, কপালে তিলক কাটা, হাতে ভারতের পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই প্রৌঢ় এখন ভাইরাল।কেউ কটাক্ষ করে তাঁকে বলছেন, ছাত্র দাদু! কারও কারও অভিমত, তিনি নাকি প্রলয়ের সামনে ডমরু বাজাচ্ছিলেন! যিনি যা-ই ভাবুন কিংবা বলুন, নবান্ন অভিযানের পর ওই প্রৌঢ়কে নিয়েই ব্যস্ত নেট-নাগরিকদের একটা বড় অংশ।
কিন্তু সেই ভাইরাল ‘সাধুবাবা’ আসলে কে? পরিচয় জানতে না-পেরে অনেকে তাঁকে ‘তারানাথ তান্ত্রিক’ও বলছেন! আসলে তাঁর নাম প্রবীর বসু, থাকেন শ্যামবাজার স্ট্রিটে। এলাকায় মানুষ তাঁকে বলরাম নামেই চেনেন। সেখানে ১৭৫ বছরের পুরোনো বসতভিটে তাঁদের। উত্তর কলকাতার বনেদি পরিবার বলতে যা বোঝায়, বছর ৫৬-র, রক্তজবা বসনধারী মানুষটি তেমনই এক পরিবারের সদস্য। জলকামানের মুখোমুখি হওয়ার পর তিনি মন্তব্য করেন, ‘পুলিশ হাতে চুড়ি পরে বসে আছে।’ যা নিয়ে তাঁকে তীব্র কটাক্ষ শুনতে হচ্ছে নেট নাগরিকদের একাংশের থেকে।
তবে বলরাম বলছেন, ‘যাঁরা আমাকে নিয়ে চর্চা করছেন, তাঁরা আসলে আরজি করের ঘটনা থেকে ফোকাস ঘোরাতে চান। আমি এক জন সাধারণ মানুষ। আমার একটা মেয়ে আছে। ২৭ বছর বয়স। আমার স্ত্রী আছেন। আমি সব মেয়ের নিরাপত্তার দাবিতেই পথে নেমেছিলাম। রাত দখলের রাতেও (১৪ অগস্ট) রাস্তাতেই ছিলাম।’ বলরাম অবশ্য মেনে নিচ্ছেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি আরএসএস করেন।
তাঁর কথায়, ‘আমি কোনও রাজনৈতিক দল করি না। বিজেপিও করি না। আরএসএস কোনও রাজনৈতিক দল নয়, বিশ্বের সব চেয়ে বড় সামাজিক সংগঠন। আমি আরএসএস করি।’ কিন্তু হঠাৎ তিনি চুড়ি পরে বসে থাকার কথা বললেন কেন? সেটা কি নারীবিদ্বেষী মন্তব্য নয়? এই প্রশ্নের মুখে বলরাম খানিক থমকান। তার পর তিনি বলেন, ‘নারীদের প্রতি বিদ্বেষ নিয়ে কিছু বলতে চাইনি। আমি বলতে চেয়েছি, পুলিশ হাতে দাসত্বের চুড়ি পরে আছে।’
তবে বলরাম যা-ই বলুন, তাঁর মন্তব্যের প্রেক্ষিতে, বলা ভালো, তাঁর মন্তব্যের পাল্টা ফেসবুক-সহ সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে স্লোগান— ‘চুড়ি পহনকে হল্লা বোল, শাড়ি পহনকে হল্লা বোল।’ টিভি-তে বলরামের চুড়ি-মন্তব্য শোনার পর এই স্লোগান এই দফায় প্রথম তোলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপিকা মেরুনা মুর্মু।
তাঁর কথায়, ‘উনি (প্রবীর ওরফে বলরাম) এখন যতই কথা ঘোরাতে চান, এই সব নারীবিদ্বেষী কথা তো আজকের নয়। ছেলেরা কিছু না-পারলেই চুড়ি পরে ঘরে বসে থাকার কথা চলে আসছে। এখন তিনি অন্য কথা বললে কী হবে? আসলে তো নারীকে দুর্বল মনে করেই তিনি ওই কথা বলেছেন।’
বলরাম দাবি করছেন, ভাইরাল হওয়ার পর থেকে তিনি খুব ব্যস্ত। আপাতত তাঁর মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতেই অনেকটা সময় চলে যাচ্ছে। তিনি এক সময়ে ফটোগ্রাফি করতেন। এখন তিনি সেটা শেখান, আর করেন সাধনা। সেই কারণেই রক্তজবা বসন। মানুষের মুক্তি কী ভাবে হবে, সাধনায় তিনি সেই রাস্তা খুঁজছেন। বলরামের কথায়, ‘আমার এখন বানপ্রস্থ চলছে। আমাদের শাস্ত্রে আছে, সন্ন্যাস জীবনের আগে বানপ্রস্থ হয়।’
বলরাম ওরফে প্রবীরকে ব্যক্তিগত ভাবে চেনেন, এমন অনেকে অবশ্য দাবি করছেন, এ সব পুরোটাই ভেক। তথ্যচিত্র নির্মাতা ও প্রাবন্ধিক সৌমিত্র দস্তিদার লিখেছেন, ‘হাফপ্যান্ট পরে গোয়াবাগান পার্কে কুচকাওয়াজ করতেন (বলরাম)। দাঁত পড়ে যাওয়ায় বয়সের তুলনায় বৃদ্ধ লাগে। কিছুদিন ধরে উনি এই রক্তজবা পোশাক পরছেন। কিন্তু উনি মোটেও সন্ন্যাসী নন। সর্বত্যাগী তো নন-ই।’