• পলিটিক্স-প্যাঁচে লঘু হচ্ছে আরজি কর আন্দোলন?
    এই সময় | ২৯ আগস্ট ২০২৪
  • এই সময়: কেউ লিখেছেন, 'সারা দিনের ঘটনা দেখে আশঙ্কা হচ্ছে তিলোত্তমার জন্য ন্যায়বিচারের ফোকাসটা রাজনীতির কানাগলিতে বুঝি হারিয়ে গেল।' কেউ বলছেন, '১৪ অগস্ট রাতে যে নির্দলীয় গণ-রাগ মানুষের দেখা গিয়েছিল, সেটাকেই গুলিয়ে দিতে শুরু হয়েছে আন্দোলন দখল করার খেলা।' কারও অভিমত, 'অপরাধীদের সুযোগ করে দিতেই হাথরস, উন্নাও, মণিপুরের অভিযুক্তরা এবং ব্রিজভূষণের বন্ধুরা পথে নেমেছে। বন্ধুরা সতর্ক থাকুন। নজর ঘোরাতে দেবেন না।'তিনটি লেখাই যাঁরা লিখেছেন, তাঁরা কেউ সেলেব্রেটি নন। তথাকথিত আন্দোলনজীবী বলে যাঁদের কটাক্ষ করা হয়, এই বয়ান তাঁদেরও কারও নয়। একেবারে সাধারণ মানুষের কথা। যাঁরা আরজি কর হাসপাতালের ওই ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় ক্ষুব্ধ। প্রতিদিন জাস্টিসের দাবিতে যাঁরা রাস্তায় নামছেন। আশঙ্কাটা আসলে তাঁদেরই।

    প্রথমে 'পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র সমাজ'-এর নাম করে নবান্ন অভিযানের ডাক। যে মিছিলে সামিল হওয়া মুখগুলো আন্দোলনে নামা মানুষদের কাছে ভীষণই 'অচেনা'। সেই অভিযানে ভাঙচুর, ইট-পাটকেল। যাঁদের ইট ছুঁড়তে দেখা গেল, তাঁরা ঠিক কোথাকার ছাত্র, প্রশ্নটা ঘুরতে শুরু করেছে নেট-মহলে। বিশৃঙ্খল, মারমুখী সেই প্রতিবাদীদের আটকাতে চলেছে পুলিশের কাঁদানে গ্যাস, লাঠি আর জল কামান। ঝরেছে রক্ত। চোখ হারাতে বসেছেন এক পুলিশকর্মী। আর তার ঠিক পরে পরেই অনুসারী হিসেবে বুধবার বিজেপির বাংলা বন্‌ধের ডাক। সেই বন্‌ধ সফল করতে আবার গা জোয়ারি। পাল্টা শাসকদলের রাস্তায় নামা। আবার পুলিশের লাঠি।

    আরজি করের ঘটনার পরে যে শিক্ষিত বাঙালি সমাজ সবকিছু ভুলে রাস্তায় নেমে পড়েছে, তাদের প্রশ্ন, এই রাজনৈতিক আকচাআকচিতে কি আদপে হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিবাদী সাধারণ জনতার স্বর, জাস্টিস ফর আরজি কর? এমন আশঙ্কার মধ্যেও অবশ্য গণআন্দোলনকে কোনও রাজনৈতিক দলের সংস্রব ছাড়াই চালিয়ে যেতে বদ্ধ পরিকর নাগরিক মহল।

    'ছাত্র সমাজ'-এর নবান্ন অভিযান এবং বন্‌ধ নিয়ে বিজেপির আচরণ দেখার পর রাত দখলের প্রথম কারিগর রিমঝিম সিনহার আশঙ্কা, 'বিলকিসের ধর্ষকদের যারা ছাড়িয়ে আনে, কাঠুয়ায় ধর্ষকদের হয়ে বিজয় মিছিল করে, হাথরস, উন্নাও, মণিপুর ঘটায়, তারা নারী নির্যাতনের প্রতিবাদের জন্য ছদ্মবেশ নিয়েছে। এই সব হুলিগানদের নিয়ে এসে আসলে মানুষের আন্দোলন থেকে নজর ঘোরাতে চাইছে।'

    রাত দখলের আরও এক কারিগর সমাজকর্মী শতাব্দী দাসও মনে করেন, আসলে তদন্তের গতিপথ নিয়ে যাতে আলোচনা না-হয়, সে দিক থেকে নজর ঘোরাতেই শহরের পথে নৈরাজ্য চালাতে নেমেছে একদল। শতাব্দীর কথায়, 'কিন্তু এতে মানুষের আন্দোলনে কোনও ক্ষতি হবে না।'

    ২৮ তারিখে যখন বন্‌ধ সফল করতে রাস্তায় নেমেছে বিজেপি, তখনও কিন্তু বিজেপির কথা না-শুনে বহু সংগঠন, মানুষ রাস্তায় নেমেছেন জাস্টিসের দাবিতে। আজ বৃহস্পতিবার কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত মিছিল ডেকেছে নাগরিক সমাজ। যেখানে যুক্ত হচ্ছেন ময়দানের খেলাপ্রেমীরাও। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মেরুনা মুর্মুর কথায়, 'এখন মানুষের প্রতিবাদের স্পিরিটটা এমন জায়গাতেই রয়েছে যে রাস্তায় নেমে নৈরাজ্য চালিয়ে যারা নজর ঘোরাতে চায়, তাদেরও মানুষ রিজেক্ট করছে।'

    তৃণমূল আগাগোড়াই বিজেপিকে আক্রমণ করছে। মানুষের গণ-আন্দোলনকে তাঁরা সরাসরি আক্রমণ করেনি। তবে মঙ্গল ও বুধবারের পরে সব গণ-আন্দোলনকেই 'বিজেপি' বলে দাগিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের কি সুবিধে হলো - প্রশ্ন তুলছেন চিন্তাশীল মানুষ। সিপিএম নেত্রী দিপ্সীতা ধর মনে করেন, 'তৃণমূলকে সুবিধে করে দিতেই ছদ্মনামে নবান্ন অভিযান করে, বন্‌ধ ডেকে বিজেপি এ সব করছে। ওদের আসল ইচ্ছে যেনতেন প্রকারেণ মাস মুভমেন্টকে হাইজ্যাক করে ক্ষমতায় পৌঁছনো।'

    নাট্য ব্যক্তিত্ব সোহিনী সেনগুপ্তর আশঙ্কা, 'ভাঙচুর, রক্তারক্তি করে তো বিচার হয় না। এই কারণ দেখিয়ে সব গণ-আন্দোলনকেই কি এ বার দাগিয়ে দিয়ে বাধা দেওয়া হবে? সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ মিছিল তো এই ভাবে চলছে না। তা হলে এই ব্লেম গেমে কেন ক্ষমতাসীন দলগুলো নাগরিক প্রতিবাদকে সামিল করতে চাইছেন?' অভিনেত্রী অপরাজিতা আঢ্য লিখেছেন, 'শিক্ষার ও শিক্ষিতের ডাক। নতুন যৌবনের ডাকে মানুষের প্রতিবাদ চলছে। ছাত্র সমাজ বুক পাততে জানে। তারা পুলিশকে ঢিল ছুড়তে পারে এটা আমি বিশ্বাস করি না। যারা ঢিল ছোড়ে তারা কখনও ছাত্র সমাজ হতে পারে না।'

    বিজেপি অবশ্য এই অভিযোগ মানছে না। দলের রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যের দাবি, রাত দখলের ডাক থেকে নাগরিক মিছিল, দলীয় পতাকা ফেলে সেই মিছিলে বিজেপির কর্মী-সমর্থকরা না থাকলে সেগুলি সফল হতো না। শমীকের মতে, 'গণতন্ত্রে শাসকের বিরুদ্ধে যে কোনও গণ-আন্দোলনকে রাজনৈতিক পরিসরে প্রতিফলিত করতে পারে বিরোধীরাই। আমরা সেই কাজটাই করছি।'
  • Link to this news (এই সময়)