• অভিযানের পরে বন্‌ধেও বিক্ষিপ্ত হিংসা, ভাটপাড়ায় চলল গুলি
    এই সময় | ২৯ আগস্ট ২০২৪
  • মণিপুস্পক সেনগুপ্ত

    বুধবার সকালে তখন মুর্শিদাবাদ স্টেশনে ঠায় দাঁড়িয়ে ভাগিরথী এক্সপ্রেস। বন্‌ধ সফল করতে ট্রেনের সামনে পদ্মের ঝান্ডা পুঁতে দিয়েছেন মুর্শিদাবাদের বিজেপি বিধায়ক গৌরীশঙ্কর ঘোষ ও তাঁর অনুগামীরা। প্রতিবাদ করেন জনৈক ট্রেনযাত্রী রাজু হালদার। লাইনের উপর বসে বন্‌ধের সমর্থনে স্লোগান দিতে থাকা বিজেপি কর্মীদের কাছে তাঁর আর্জি ছিল, ‘আমাকে পাঁচশো টাকা দিন। অবরোধের জন্য আমি সঠিক সময়ে কাজে যোগ দিতে পারব না। আমার একদিনের মজুরি কাটা যাবে। আপনারা আমাকে একদিনের মজুরি দিন।’তাঁর এই আর্জিতে বিজেপি কর্মীরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেও বিষয়টি মনে ধরে ট্রেনে আটকে থাকা নিত্যযাত্রীদের। তাঁরাও ট্রেন থেকে নেমে রাজুর সুরে সুর মেলাতে শুরু করেন। বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আগেই বিজেপি কর্মীরা রাজুর দিকে লাঠি হাতে ধেয়ে যান। পুলিশের সামনেই তাঁকে বেধড়ক পেটানো হয় বলে অভিযোগ। শেষমেশ মুর্শিদাবাদ থানার পুলিশ ও আরপিএফ পরিস্থিতি সামাল দেয়।

    বুধবার বিজেপির ডাকা ১২ ঘণ্টার বাংলা বন্‌ধে এই রকম বিক্ষিপ্ত হিংসার ছবি বিচ্ছিন্ন ভাবে রাজ্যের প্রায় সব জেলাতেই দেখা গেল। একইসঙ্গে দেখা গিয়েছে বন্‌ধকে পাত্তা না দিয়ে সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশের জনজীবন স্বাভাবিক রাখার প্রচেষ্টাও। কলকাতা ও শহরতলিতে বিজেপি নেতারা এ দিন সকালে রাস্তায় বেরিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছে হাতজোড় করে অনুরোধ করেন দোকানপাট বন্ধ রাখার জন্য।

    শ্যামবাজার, গড়িয়াহাট, সল্টলেক, বড়বাজারে বন্‌ধের সমর্থনে মিছিল করেন রাহুল সিনহা, লকেট চট্টোপাধ্যায়, শমীক ভট্টাচার্য, অগ্নিমিত্রা পল, সজল ঘোষরা। তাতে বিশেষ সাড়া মেলেনি। গন্ডগোলের আশঙ্কায় রাস্তাঘাটে লোকজন অন্যদিনের থেকে বেশ খানিকটা কম থাকলেও মোটের উপর কলকাতার জনজীবন স্বাভাবিকই ছিল।

    মঙ্গলবার ‘পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র সমাজ’-এর নবান্ন অভিযানে পুলিশি ‘আক্রমণে’র অভিযোগ তুলে এ দিন ১২ ঘণ্টার বন্‌ধ ডাকে বিজেপি। রাতেই বন্‌ধের বিরোধিতা করে কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়। এ দিন সকালে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ মামলাটি খারিজ করে দেয়।

    হাইকোর্টের নির্দেশ নিয়ে সরাসরি মন্তব্য না-করলেও এ দিন ধর্মতলায় দলীয় সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘মহারাষ্ট্রের বদলাপুরের ঘটনার প্রেক্ষিতে সে রাজ্যের বিরোধীরা ধর্মঘট ডেকেছিল। কিন্তু সরকার হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়। আদালত বন্‌ধকে বেআইনি ঘোষণা করে। অথচ আমাদের রাজ্যে মামলাটাই শোনা হলো না। আমি আইনজীবীদের বলব, আগামী দিনে তাঁরা যেন এই সব বিষয়ে আরও একটু যত্নবান হন।’

    কলকাতা লাগোয়া শহরতলি এবং বেশ কিছু জেলায় গেরুয়া নেতাদের বন্‌ধ সফল করতে বলপ্রয়োগ করতেও দেখা গিয়েছে। এমনকী, বিজেপির বন্‌ধ চলাকালীন এ দিন গুলি পর্যন্ত চলেছে ব্যারাকপুর লাগোয়া ভাটপাড়ায়। বুধবার সকালে ভাটপাড়ার কলাবাগান সংলগ্ন ঘোষপাড়া রোডে বিজেপি নেতা অর্জুন সিং ঘনিষ্ঠ বিজেপি নেতা প্রিয়াঙ্গু পান্ডের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালানোর অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। রবি সিং ও রবি বর্মা নামে দু’জন বিজেপি কর্মী তাতে জখম হন।

    শিলিগুড়িতে বন্‌ধ সফল করতে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপায় বিজেপি। সকাল থেকে শহরের নানা প্রান্তে তাণ্ডব চালানোর অভিযোগ ওঠে বিজেপির বিরুদ্ধে। সরকারি বাস ভাঙচুর, জোর করে দোকান বন্ধ করে দেওয়া, রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ করে বিজেপি বন্‌ধ সফল করার চেষ্টা করলেও শিলিগুড়ির জনজীবন তারা স্তব্ধ করতে পারেনি। স্কুল বাস থেকে ছাত্রছাত্রীদের নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে শিলিগুড়ির বিজেপি বিধায়ক শঙ্কর ঘোষের বিরুদ্ধে।

    এছাড়াও জলপাইগুড়ি, মালদা, পশ্চিম মেদিনীপুরের বেশ কিছু জায়গায় এ দিন বন্‌ধকে কেন্দ্র করে বিক্ষিপ্ত ভাবে বিজেপি-তৃণমূল সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বিজেপির রেল অবরোধকে কেন্দ্র করে হুগলির কিছু জায়গায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয় এ দিন। বন্‌ধ চলাকালীন হুগলির মানকুণ্ডু স্টেশনে উত্তেজনা যখন চরমে, তখনই কথা কাটাকাটিতে জড়ান কর্তব্যরত পুলিশকর্মী এবং লোকোপাইলট।

    পুলিশ দাবি করে, হুইস্‌ল দিয়ে রেললাইন থেকে অবরোধকারীদের যেন সরানোর চেষ্টা করেন লোকোপাইলট। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রস্তাব উড়িয়ে তিনি উল্টে পুলিশকে বলেন, ‘লাইন আপনি ক্লিয়ার করুন। আমি এত মানুষকে অসুবিধায় ফেলতে পারব না।’

    মঙ্গলবার ‘ছাত্র সমাজ’-এর ডাকা নবান্ন অভিযানকে কেন্দ্র করে তাণ্ডবের পর বুধবারও বিজেপির ডাকা বাংলা বন্‌ধে জায়গায় জায়গায় অশান্তির খণ্ডচিত্রের মধ্যে নির্দিষ্ট যোগসূত্র আছে বলে মনে করছেন অনেকেই। এটা পরিকল্পিত ভাবে বাংলাকে বদনাম করার চেষ্টা বলেই দাবি রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের। তাদের অভিযোগ, ‘ছাত্র সমাজ’-এর নবান্ন অভিযান কর্মসূচি সফল করতে মঙ্গলবার জাতীয় পতাকা হাতে রাজপথে নেমেছিলেন বিজেপি কর্মীরা।

    ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতে তাঁদেরই দেখা গিয়েছে দলীয় ঝান্ডা হাতে বন্‌ধের সমর্থনে রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়তে। আশান্তি পাকানোর জন্য এ দিন কলকাতা থেকে মোট ৭৬ জন বিজেপি কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। যার মধ্যে ১২ জন মহিলা। রাহুল সিনহা, শমীক ভট্টাচার্য, লকেট চট্টোপাধ্যায়-সহ প্রথম সারির বহু বিজেপি নেতা-নেত্রীকে এ দিন আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। কলকাতার বিজেপি কাউন্সিলার সজল ঘোষকেও পুলিশ বাড়ি থেকে আটক করে। তৃণমূলের তরফে এ দিনের বন্‌ধকে ‘ফ্লপ শো’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

    বিজেপির বন্‌ধের মধ্যেই ধর্মতলায় গান্ধী মূর্তির পাদদেশে সভা করে তৃণমূলের ছাত্র-সংগঠন। সেখানে হাজির ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়রা। অভিষেক এ দিনের বন্‌ধকে খোঁচা দিয়ে বলেন, ‘বিজেপি নেতাদের অনুরোধ করব, প্রতি বছর ২৮ অগস্ট বন্‌ধ ডাকুন। মানুষ জানে, কী ভাবে কর্মনাশা বন্‌ধের মোকাবিলা করতে হয়।’

    বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের দাবি, ‘বন্‌ধ পুরোপুরি সফল। সাধারণ মানুষ আমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছে। তৃণমূল ভয় পেয়েছে বলেই পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল বন্‌ধ ব্যর্থ করতে। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি।’
  • Link to this news (এই সময়)