এই সময়: ওঁরা মূলত থাকেন ইউরোপ-আমেরিকায়। অনেকেই পেশায় চিকিৎসক। তাঁদের এমবিবিএস শিক্ষার শিকড় গাঁথা কলকাতায়, নিদেনপক্ষে বাংলায়। আরজি করে তরুণী চিকিৎসকের খুন-ধর্ষণের ঘটনা ছুঁয়ে গিয়েছে তাঁদেরও। সঙ্গে রয়েছেন অন্য পেশায় বিদেশে থাকা আরও অসংখ্য বাঙালি।সকলেই জাস্টিস ফর আরজি কর আন্দোলনে সামিল হতে চান। সশরীরে না-থাকতে পারার যন্ত্রণাকে ভোলাতে কোনও না কোনও ভাবে হাত বাড়াতে চান। তাই, আন্দোলনের খরচ তুলতে উদ্যোগী হয়েছেন অনেকেই। ছ’টি চিকিৎসক সংগঠনের যৌথ মঞ্চের কর্তারা জানাচ্ছেন, চলতি আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিতে একপ্রকার মরিয়া প্রবাসীরাও।
কিন্তু চাইলেও, তাঁদের অনুদান গ্রহণ করার উপায় নেই। বাধ সেধেছে বৈদেশিক মুদ্রা আইন। বিদেশের এই অনুদান পেতে এ বার তাই বৈদেশিক মুদ্রা গ্রহণের জন্য নিয়ম মেনে ফর্ম পূরণের প্রক্রিয়ার পথে হাঁটতে চলেছে কলকাতার চিকিৎসক সংগঠন। এই অনুমতি দেওয়ার কথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের। এক চিকিৎসকের কথায়, ‘দেখা যাক। এ বার কেন্দ্র সরকার কতটা সহমর্মিতা দেখায়।’
১৯৯৬-তে বিলেতে যাওয়া ইউকে-র লিঙ্কন শহরের ফরেন্সিক সাইকিয়াট্রির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ন্যাশনাল মেডিক্যালের প্রাক্তনী পাঞ্চজন্য ঘটক বলছেন, ‘গত সপ্তাহে ন্যাশনাল মেডিক্যালের বিলেত প্রবাসী প্রাক্তনীদের রি-ইউনিয়ন ছিল। সেখানেও পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে ছিল আরজি করের আলোচনা। উপস্থিত শতাধিক চিকিৎসক মানসিক ভাবে এবং আর্থিক ভাবে এই আন্দোলন সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাঙালি-সহ গোটা ইউ-কের অন্তত ৭০০ ভারতীয় ডাক্তার অর্থসহায়তায় রাজি।’
বস্টন-প্রবাসী বাঙালি ইঞ্জিনিয়র অভিজিৎ ব্রহ্মচারী জানাচ্ছেন, একই রকম ভাবে এই ঘটনা নাড়া দিয়েছে ইউএসএ প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে। সেখানে বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছেন। বিবিসি-র মতো টিভি চ্যানেল ও পোর্টাল এবং ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল, ল্যান্সেটের মতো বিজ্ঞান পত্রিকাও এই ঘটনা রিপোর্ট করেছে। ফলে আবেগের নিরিখে অভিবাসী বাঙালিদের মনেও একই রকম ছাপ ফেলেছে এই ঘটনা।
ইংল্যান্ডের বোর্ন মাউথের বাসিন্দা প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, আরজি করের প্রাক্তনী শ্রাবণী মুখোপাধ্যায় বৃহস্পতিবার বলেন, ‘সাঙ্ঘাতিক ট্রমায় আছি। আমার কলেজেই এত বড় ঘটনা! ওখানকার আন্দোলনে পাশে সর্বতো ভাবে আছি। অর্থাভাব যেন কোনও ভাবে এই আন্দোলনে প্রভাব না ফেলে। বিচার চাই। শেষ দেখে ছাড়ব।’
যৌথ মঞ্চের যুগ্ম আহ্বায়ক পূণ্যব্রত গুণ বলেন, ‘যৌথ মঞ্চের কোনও নিজস্ব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। তাই তহবিল গড়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে ওয়েস্টবেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম এবং অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টর্সের অ্যাকাউন্ট। ওরা মূলত আইনি লড়াইয়ের জন্য তহবিল সংগ্রহ করছে। আর শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের তরফে ধর্না মঞ্চের দৈনন্দিন খরচ জোগাড় করা হচ্ছে। মঞ্চ, মাইক আর খাবার ও জল নিয়ে রোজ গড়ে ১০-১২ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।’
লাগাতার এই খরচ জোগাতে শুধু এখানকার বা ভিন রাজ্যের চিকিৎসকরাই নয়, এগিয়ে এসেছেন প্রবাসী বাঙালি চিকিৎসকরাও। বিদেশি কোনও অ্যাকাউন্ট থেকে বড় অঙ্কের অর্থ গ্রহণে সমস্যা রয়েছে। ইনস্টিটিউট অফ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অফ ইন্ডিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় প্রাক্তন চেয়ারপার্সন সোনু জৈন জানাচ্ছেন, ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে বিদেশ থেকে টাকা পাঠানো গেলেও, সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট-এ নথিভুক্ত কোনও সংগঠন বা সংস্থা (যেমন এনজিও) অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে গেলে ফরেন কারেন্সি রেগুলেশন অ্যাক্ট (এফসিআরএ) মেনে একটি ফর্ম পূরণ করতে হয়।
অনুমোদন এলে, বিদেশি অর্থ গ্রহণে সমস্যা নেই। ওয়েস্টবেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম সূত্রে খবর, তারা সংস্থার চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের সঙ্গে পরামর্শ করে সেই রাস্তাতেই হাঁটছেন। চিকিৎসক সংগঠনগুলি সূত্রে জানা গিয়েছে, আন্দোলন চালাতে বিভিন্ন কর্মসূচির পিছনে জলের মতো টাকা খরচ হচ্ছে। একটা মিছিল আয়োজনে খরচ ন্যূনতম ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা। দিনভর আরজি কর, কলকাতা মেডিক্যালের ধর্না মঞ্চ ভরিয়ে রাখতে ইলেকট্রিক, মাইক, খাবার, জল ইত্যাদি মিলিয়ে খরচ অন্তত ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা।
সুপ্রিম কোর্টে চলা আরজি কর নিয়ে মামলায় একটা শুনানি মানেই আইনজীবীদের ফি বাদে শুধুমাত্র যাতায়াত ও থাকা-খাওয়া বাবদ খরচ কমপক্ষে লাখ দেড়েক টাকা। আইনজীবী করুণা নন্দী ও তাঁর টিম কোনও ফি নিচ্ছেন না। এই বিপুল খরচের দায়ভার ছ’টি চিকিৎসক সংগঠনের যৌথ মঞ্চের পাশাপাশি বইছে মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টার, সার্ভিস ডক্টর্স ফোরামের মতো বেশ কিছু চিকিৎসক সংগঠন। ওয়েস্টবেঙ্গল ডক্টর্স ফোরামের সভাপতি কৌশিক চাকী জানাচ্ছেন, আরজি করের মর্মান্তিক ঘটনায় প্রবাসী চিকিৎসকরাও বিপর্যস্ত, শোকস্তব্ধ। ফুঁসছেন সব পেশার প্রবাসীরা।
প্রতিবাদে, আইনি লড়াইয়ে তাঁরাও প্রত্যক্ষ ভাবে না হলেও পরোক্ষ সাহায্য করতে চান, অর্থ সাহায্যও যার অন্যতম। সংগঠন সূত্রে খবর, যতদিন না বিদেশি অনুদান গ্রহণের অনুদান মিলছে, ততদিন প্রবাসীরা নিজেদের ভারতীয় অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেই অর্থ পাঠাবেন। কিন্তু ২৫-৩০ বছর ইউরোপ-আমেরিকায় থাকা অনেকেরই এখন আর এ দেশে অ্যাকাউন্ট নেই। তাঁদের জন্য এবং বিদেশি চিকিৎসক সংগঠনের জন্যই বিদেশি মুদ্রা গ্রহণের প্রয়োজনীয় অনুমতি এখন জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে।