এই সময়: আরজি করে সেমিনার রুমে ‘লাল জামা’ পরা ব্যক্তি আসলে কে? এই ইস্যুতে শুরু হয়েছে প্রবল বিতর্ক। তারই মধ্যে শনিবার ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (আইএমএ)-এর বেঙ্গল শাখার একটি পোস্ট সেই বিতর্ককে আরও উস্কে দিয়েছে। সংগঠনের দাবি, আরজি করের সেমিনার রুমের অকুস্থলে ঘোরাঘুরি করা লাল টি-শার্ট পরা ব্যক্তি আসলে ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র ঘনিষ্ঠ স্নাতকোত্তর পড়ুয়া-চিকিৎসক অভীক দে। বর্তমানে তিনি পিজি হাসপাতালে জেনারেল সার্জারিতে এমএস পড়ুয়া।আরজি করের ঘটনার পরে নির্যাতিতার মা-বাবা প্রথম থেকে অভিযোগ তুলছিলেন যে, লাল টি-শার্ট পরা এক ব্যক্তি সন্দেহজনক ভাবে ঘটনাস্থলে ঘোরাঘুরি করছিলেন। খুন-ধর্ষণের ঘটনার পরে সেমিনার রুমে ভিড় করেছিলেন অনেকেই। সেই ভিডিও ফুটেজ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে শুক্রবার ডিসি (সেন্ট্রাল) ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, লাল টি-শার্ট পরা ওই ব্যক্তি আসলে পুলিশের-ই ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট। কলকাতা পুলিশের এমন দাবিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছে আইএমএ।
কেননা, ওই ভিডিয়ো ফুটেজের নানা অংশের স্ক্রিন শট জ়ুম করে চিকিৎসকদেরও একটা বড় অংশের দাবি, ওই ব্যক্তি আসলে অভীক-ই। আইএমএ রাজ্য শাখার জুনিয়র ডক্টর্স নেটওয়ার্কের কনভেনর রৌনক হাজারি বলেন, ‘যত দূর জানি, ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞ মানে তিনি ফরেন্সিক বিভাগের হন। কিন্তু অভীক তো রেডিওলজির আরএমও-কাম-ক্লিনিক্যাল টিউটর ছিলেন। আর এখন জেনারেল সার্জারিতে স্নাতকোত্তর করছেন। তা হলে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ হলেন কী করে! সবচেয়ে বড় কথা, তিনি ওখানে গেলেন কেন? অভীক তো আরজি করের কেউ নন!’
একই বক্তব্য আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদেরও। তাঁদেরই অন্যতম এক পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি (পিজিটি) বলেন, ‘অভীক তো উত্তরবঙ্গ লবির লোক। পুরো ব্যাপারটা সামলানো ও ধামাচাপা দেওয়ার মোটিভ নিয়েই সম্ভবত এসেছিলেন। তিনি বহিরাগত। তা হলে কেন ওঁকে সেমিনার রুমে দেখা গেল? আমরা চাই, পুরো বিষয়টা তদন্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সামনে আসুক।’
কে এই অভীক দে? চিকিৎসকরাই জানাচ্ছেন, বর্ধমান শহরের ছেলে অভীক উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে ঢুকেছিলেন ২০১০-এ। আর পাশ করেন ২০১৫ সালে। তার পর থেকেই তিনি শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে উত্তরবঙ্গ লবির ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। অভিযোগ, বকলমে রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রশাসন চালানো একটি গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ অভীক।
স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রের দাবি, ২০২১-এর জানুয়ারিতে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে রেডিওলজি বিভাগে আরএমও হিসেবে যোগ দেন তিনি। অভিযোগ, কলেজে তাঁর প্রভাব ছিল বিস্তর। আরও অভিযোগ, রাজ্যের বর্তমান স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা কৌস্তভ নায়েক বর্ধমান মেডিক্যালের অধ্যক্ষ থাকাকালীন ২০২২-এ অভীককে একটি সার্টিফিকেট লিখে দেন, যাতে বলা ছিল, অভীক বর্ধমান মেডিক্যালেরই অ্যানেক্স ক্যাম্পাস ‘অনাময়’তে কাজ করেন।
অনাময় যেহেতু পঞ্চায়েত এলাকায়, তাই ‘রুরাল সার্ভিস কোটা’র সুযোগ নিয়ে সহজেই অভীক এসএসকেএম হাসপাতালের জেনারেল সার্জারিতে স্নাতকোত্তর এমএস কোর্সে ঢোকেন ২০২৩-এ। অনেকেরই প্রশ্ন, কোন ক্ষমতাবলে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল এবং রাজ্য ফার্মেসি কাউন্সিলেও নির্বাচিত ও মনোনীত সদস্য হয়ে গেলেন তিনি?
চিকিৎসক হিসেবে যথেষ্ট প্রভাবশালী বলে পরিচিত রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের সভাপতি তথা আরজি করের রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান সুদীপ্ত রায় শনিবার ‘এই সময়’কে বলেন, ‘৯ অগস্ট মেডিক্যাল কাউন্সিলের মিটিং ছিল। সেখানে আমি সহ-সভাপতি সুশান্ত রায় এবং নির্বাচিত সদস্য হিসেবে অভীকও ছিলেন। কাউন্সিল অফিসেই আমরা আরজি করের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার খবর পাই। তখন আমার সঙ্গে আরজি করে গিয়েছিলেন সুশান্ত ও অভীক। পুলিশ যে লাল টি-শার্ট পরা ব্যক্তিকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তাঁকে আমি চিনি না। তবে ছবির ওই ব্যক্তি অভীক নন।’
রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা কৌস্তুভ নায়েক বলেন, ‘কে কোথায় ছিল, কেন ছিল, তার দায়ভার আমি কেন নেব? আমি তো কাউকে ডাকিনি।’ শুক্রবার কলকাতা পুলিশ লাল জামা পরা ব্যক্তিকে চিহ্নিত করলেও, আইএমএ-র তোলা অভিযোগের জবাবে শনিবার সরকারি ভাবে কিছু জানায়নি। এদিন অভীকের ফোনও দিনভর ছিল ‘নট রিচেবল’।
জবাব দেননি হোয়াটসঅ্যাপ টেক্সটেরও। তবে চিকিৎসকদেরই একটি অংশের মত, অকুস্থলে যে ছবি ভাইরাল হয়েছে, আর আইএমএ যে ছবি প্রকাশ করেছে, দু’টি আলাদা। ফলে ওই ব্যক্তি অভীক না-ও হতে পারেন। ফলে এ ভাবে বিতর্ক তৈরির নামে তদন্তকে প্রভাবিত করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ ওই চিকিৎসকদের।