আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে গোটা বাংলা যখন তোলপাড়, তখন কেন্দ্রের তথ্য ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে নারী সুরক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ‘নির্ভয়া তহবিল’ গঠনের প্রায় এক দশক পরেও সেই তহবিলে বরাদ্দ টাকা খরচে পিছিয়ে বাংলা! ওই তহবিল থেকে কোন রাজ্য কত টাকা পেয়েছে আর তার থেকে কত খরচ হয়েছে, তা ২০১৯ সালে জানতে চেয়েছিলেন অন্যদের সঙ্গেই পশ্চিমবঙ্গের দুই সাংসদ। তাঁরা হলেন তৃণমূলের মালা রায় এবং কংগ্রেসের অধীররঞ্জন চৌধুরী। তার জবাবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক রাজ্যওয়াড়ি যে হিসাব সংসদে জমা দিয়েছিল, তাতে দেখা যাচ্ছে, সেই সময় পর্যন্ত বাংলার জন্য কেন্দ্র বরাদ্দ করেছিল ৭৫.৭০৮ কোটি টাকা। আর রাজ্যের তরফে কেন্দ্রকে পাঠানো খরচের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৯৩ লক্ষ টাকার মতো।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালে দিল্লিতে নির্ভয়াকাণ্ডের পরে কেন্দ্রের তরফে এই তহবিল গঠিত হয়। ২০১৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সরকার নির্ভয়া তহবিল তৈরি করেছিল এক হাজার কোটি টাকা দিয়ে। দেশের অর্থমন্ত্রী তখন পি চিদম্বরম। মূলত মহিলাদের নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য যে যে কর্মসূচি জরুরি, তার জন্যই ওই তহবিল তৈরি হয়েছিল। এর পর থেকে ফি বছরই ওই তহবিল বাবদ অর্থ বরাদ্দ হয়েছে সাধারণ বাজেটে। তাতে অন্য রাজ্যের সঙ্গে বাংলাও টাকা পেয়েছে। তারই পাশাপাশি গত ২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় বাজেটে দেশের মোট আটটি শহরের নিরাপত্তা বাড়াতে নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ‘সেফ সিটি’ তৈরির তালিকায় আমদাবাদ, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, দিল্লি, হায়দরাবাদ, লখনউ, মুম্বইয়ের সঙ্গে ছিল কলকাতাও। প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল ওই বাবদে। কলকাতা-সহ সব শহরের জন্য এখনও পর্যন্ত কেন্দ্র ওই খাতে ১,৪০৮.৩৩ কোটি টাকা পাঠিয়েছে। কিন্তু দেশে সর্বমোট খরচ হয়েছে ৮৩৬.৩৯ কোটি টাকা।
প্রথম দিকে কেন্দ্রীয় সরকার নারী সুরক্ষা খাতের সঙ্গে সঙ্গে নির্ভয়া তহবিলের জন্য যতটা পরিমাণে টাকা বরাদ্দ করত, তা ক্রমশ কমতে থাকে। ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষে মোট বরাদ্দ ছিল ৩২১ কোটি টাকা। তার মধ্যে নির্ভয়া তহবিলের জন্য রাখা হয়েছিল ১০০ কোটি টাকা। তবে চলতি অর্থবর্ষের বাজেটে তা অনেকটাই বেড়েছে। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ জুলাই মাসের সাধারণ বাজেটে নারী সুরক্ষায় বরাদ্দ তার আগের বছরের তুলনায় প্রায় সাড়ে তিন গুণ বাড়িয়ে ১,১০৫ কোটি টাকা ধার্য করেন। নির্ভয়া তহবিলে বরাদ্দ দ্বিগুণ করে হয় ২০০ কোটি টাকা।
নির্ভয়া তহবিলের টাকায় কী কী খরচ করা হবে, তা বছরে বছরে বদলেছে। শহরে-গঞ্জের রাস্তায় আলো লাগানো থেকে মহিলাদের সুরক্ষায় শহরাঞ্চলে সর্বত্র সিসিটিভি ক্যামের লাগানো, মেয়েদের জন্য চলমান শৌচাগার নির্মাণ— এ সব যেমন রয়েছে, তেমনই এই তহবিলের টাকায় নির্যাতিতাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও বলা রয়েছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন কেন্দ্রীয় নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি লোকসভায় বলেছিলেন, ‘সেন্ট্রাল ভিকটিম কমপেনসেশন স্কিম’ (সিভিসিএফ) নামে প্রকল্পে ২০১৬-’১৭ আর্থিক বছরে বাংলা পেয়েছে ১২ কোটি ৬৫ লক্ষ টাকা। খরচ করতে পেরেছে মাত্র ২০ লক্ষ টাকা।’’
কোন রাজ্যে নির্ভয়া তহবিলের অর্থ কেমন খরচ হচ্ছে, তা নিয়ে একটি বেসরকারি সংস্থা ২০১৯ সালে সমীক্ষা চালায়। সেই সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। তাতে দাবি করা হয়েছে, দেশের মধ্যে নির্ভয়া তহবিলের টাকা খরচের নিরিখে পিছনের সারিতেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। একই সঙ্গে ওই সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, শুধু বাংলা নয়, গোটা দেশেই নারী সুরক্ষায় নির্ভয়া তহবিলের ব্যবহার নিয়ে ‘সরকারি অনীহা’ প্রবল।
রিপোর্টে দাবি করা হয়েছিল, মহারাষ্ট্র কোনও টাকাই খরচ করেনি! ত্রিপুরা, তামিলনাড়ু মাত্র ৩ শতাংশ এবং মণিপুর ৪ শতাংশ খরচ করেছে। এর পরেই দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ এবং গুজরাত। তিন রাজ্যেই খরচের পরিমাণ মাত্র ৫ শতাংশ। ১৫ শতাংশের নীচে খরচ করেছে আরও ১০টি রাজ্য। ৩০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ করা রাজ্যের সংখ্যা আটটি। তার মধ্যে ছিল ২১ শতাংশ খরচ করা উত্তরপ্রদেশও। যে রাজ্যে নারী নির্যাতনের অভিযোগ বারবার জাতীয় রাজনীতির বিষয় হয়ে উঠেছে। তুলনায় বেশি খরচ হয়েছে হরিয়ানা (৩২ শতাংশ), নাগাল্যান্ড (৩৯ শতাংশ) এবং ছত্তীসগড়ে (৪৩ শতাংশ)। কোনও রাজ্যেই ৫০ শতাংশের বেশি টাকা খরচ হয়নি। ৫০ শতাংশ খরচ হয়েছে শুধু মিজোরাম এবং উত্তরাখণ্ডে।
নিয়ম অনুযায়ী, যে কোনও প্রকল্পের মোট খরচের ৬০ শতাংশ দেয় কেন্দ্র। বাকিটা রাজ্যের তহবিল থেকে আসে। তবে প্রকল্প তৈরি হলেও খরচের ব্যাপারে দেশের অনেক রাজ্যের মতোই পিছিয়ে আছে বাংলা। ২০১৯ সালে কলকাতাকে ‘নিরাপদ শহর’ বানানোর প্রকল্পের টাকা আসার পরে প্রথম দিকে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। প্রথম দফায় কলকাতা পুরসভা ২ কোটি ৮৪ লক্ষ টাকার প্রকল্প পায়। তাতে ঠিক ছিল, শহরের ১০টি গুরুত্বপূর্ণ বাজারে পরিবেশবান্ধব শৌচাগার হবে। তাতে শক্তপোক্ত দরজা, জলের ট্যাঙ্ক, বেসিন, ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা থাকবে। নিউ মার্কেট, গড়িয়াহাট, বেহালা, হাতিবাগানের মতো এলাকার বাজারে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য অনুযায়ী, কলকাতাকে ‘সেফ সিটি’ বানাতে মোট ১৮১.৩২ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি হয়েছিল। এর মধ্যে কেন্দ্রের দেওয়ার কথা ছিল ১০৮.৭৯ কোটি টাকা। ২০১৯-’২০ অর্থবর্ষে কেন্দ্র রাজ্যকে দু’দফায় ৫৫.৫৭ কোটি টাকা দেয়। পরে আরও টাকা আসায় ওই খাতে মোট ৭৫ কোটি টাকা পেয়েছে রাজ্য।
নির্ভয়া তহবিলের টাকা খরচের জন্য নানা প্রকল্পও তৈরি করে কেন্দ্র। ২০১৫ সালে নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রককে ‘নোডাল এজেন্সি’ করে দেখাশোনার ভার দেওয়া হয়েছিল তহবিলের অধীন বিবিধ প্রকল্পের। তার মধ্যে মহিলাদের অভিযোগ বা দুর্দশার কথা শুনতে ছিল ‘ওয়ান স্টপ সেন্টার’ (ওএসসি) গঠন, মেয়েদের জন্য তৈরি হেল্পলাইন নম্বরের সার্বিক উন্নয়ন, ‘মহিলা পুলিশ ভলান্টিয়ার স্কিম’ (এমপিভিএস) ইত্যাদি। দেশের সব রাজ্যকে টাকা দেওয়ার পাশাপাশি কেন্দ্রের বিভিন্ন মন্ত্রকও নির্ভয়া তহবিল থেকে বরাদ্দ পায়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে রেল সেই টাকা দিয়ে নারী সুরক্ষার কাজই করতে পারে। সব চেয়ে বেশি টাকা পায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। তবে অভিযোগ, রাজ্যের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় মন্ত্রকগুলিও সামান্য টাকা খরচ করেছে। তারও পুরোটা মহিলাদের নিরাপত্তার জন্য নয়। বরং ওই টাকা পুলিশের ফরেন্সিক ল্যাব, সাইবার অপরাধ বা অন্য বিপর্যয় মোকাবিলার পরিকাঠামো উন্নয়নে খরচ করা হয়। যদিও প্রথমে ঠিক করা হয়েছিল, মেয়েরা সরাসরি উপকৃত হবেন এমন পদক্ষেপ তথা হেল্পলাইন এবং ওয়ান স্টপ সেন্টারের পাশাপাশি আশ্রয় শিবির, ফাস্ট-ট্র্যাক কোর্ট ইত্যাদির জন্য খরচ হবে নির্ভয়া তহবিলের টাকা।
গত জানুয়ারি মাসে লোকসভায় একটি লিখিত জবাবে জানানো হয়েছিল, কেন্দ্রের বিভিন্ন মন্ত্রক তখনও পর্যন্ত খরচ করেছে ৫,৪৪৮ কোটি টাকার বেশি। তবে সরাসরি মহিলা নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। নারী ও শিশুসুরক্ষা নিয়ে কাজ করা একটি বেসরকারি সংস্থা ২০২১ সালে একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। তাতে শেষ তিন বছরে দেশে নির্ভয়া তহবিলের টাকা কেমন খরচ হয়েছে তার একটা ছবি তুলে ধরা হয়েছিল। সেই রিপোর্টে বলা হয়, টাকা শুধু যে পড়েই থাকছে তা নয়। এমন এমন খাতে খরচ হচ্ছে, যার সঙ্গে নারীকল্যাণের সরাসরি তেমন যোগ নেই। সব চেয়ে বেশি টাকা পাওয়া কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ফরেন্সিক ল্যাবের উন্নয়ন, বিপর্যয় মোকাবিলা, সাইবার অপরাধ মোকাবিলার পরিকাঠামো উন্নয়নের মতো খাতে টাকা বরাদ্দ করেছে। স্বরাষ্ট্র ছাড়াও কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণ, তথ্যপ্রযুক্তি, আইন, রেল, সড়ক ও পরিবহণের মতো মন্ত্রকের মাধ্যমে নির্ভয়া তহবিলের টাকা খরচ হওয়ার কথা। রিপোর্টে দাবি করা হয়, অধিকাংশ মন্ত্রকই সেই টাকা খরচ করেনি। সিসিটিভি বা জোরালো পথবাতির সংখ্যা বাড়ানোর মতো ‘তুলনায় সহজ’ কাজে খরচ হয়েছে অল্প কিছু টাকা।
প্রসঙ্গত, তহবিল গঠনের কয়েক বছরের মাথায় ২০১৭ সালে নির্ভয়ার মা আশা দেবীও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘‘মহিলাদের নিরাপত্তা ও ক্ষমতায়ণের বদলে রাস্তা তৈরির মতো কাজে ব্যবহার হচ্ছে নির্ভয়া তহবিলের টাকা।’’ তাঁর বক্তব্য যে ঠিক ছিল, তা স্পষ্ট বিভিন্ন সরকারি তথ্যে।