সন্দীপের গ্রেফতারি নৈতিক জয়, তবে বিনীত পদত্যাগ করলেই অবস্থান উঠবে, ঘোষণা জুনিয়র ডাক্তারদের
আনন্দবাজার | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
নিজেদের দাবিতে অনড় এবং নাছোড় মনোভাব নিয়েই লালবাজারের কাছে রাত জাগছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। এই মুহূর্তে একটাই দাবি, কলকাতার পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগ। মাঝে বিশাল লোহার ব্যারিকেড। ও পারে পুলিশের বিশাল বাহিনী কিছুটা হালকা হয়ে এসেছে। এ পারে কেউ শুয়ে রাস্তায়। কেউ বা পড়ছেন বই। কেউ কেউ দলবদ্ধ ভাবে আলোচনায় ব্যস্ত। জটলাগুলো একত্রিত করলে এ পারের ভিড় এখনও জমজমাট।
এটা ফিয়ার্স লেন। কলকাতা পুলিশের সদর দফতর লালবাজার থেকে আধ কিলোমিটার দূরে। এই আধ কিলোমিটার অতিক্রম করেই সদর দফতরে গিয়ে কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। দাবি, বিনীতকে পদত্যাগ করতে হবে। দিতে চেয়েছিলেন স্মারকলিপি। কিন্তু কলকাতা পুলিশ ডাক্তারদের সেই মিছিলকে আটকে দেয় ফিয়ার্স লেনে। সেখানেই পুলিশি ব্যারিকেডের এ পারে আটকে পড়ে পথেই বসে পড়েন তাঁরা। আর ও পারে তখন পুলিশের বড়, মেজো, সেজো, ছোটকর্তারা সার বেঁধে বসে রয়েছেন বিশাল বাহিনী নিয়ে। মাঝে দু’বার আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে দেখাও করে গিয়েছেন কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এবং যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার দুই আধিকারিক। কিন্তু পথের দাবি, হয় তাঁদের যেতে দিতে হবে বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট এবং বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের সংযোগস্থল পর্যন্ত। নতুবা বিনীতকে আসতে হবে তাঁদের কাছে। দুটোর কোনওটাই হয়নি।
এ সব যখন চলছে, সেই সময় রাত ৮টার কিছু পরে হঠাৎই খবর এল সিবিআইয়ের হাতে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে গ্রেফতার করেছে সিবিআই! হইচই পড়ে যায় বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে অবস্থানে বসা জুনিয়র চিকিৎসকদের মধ্যে। উঠল স্লোগান। এ বার কি তবে ‘অভিযান’ শেষ করবেন? অন্তত আজকের মতো? শুনেই ঠোঁট বাঁকালেন এক জুনিয়র চিকিৎসক। বুঝিয়ে দিলেন, কোনও প্রশ্নই নেই। আন্দোলনকারীরা সমস্বরে বললেন, ‘‘সন্দীপ স্যরের গ্রেফতারি আমাদের কাছে নৈতিক জয়ের মতো। তবে কলকাতার পুলিশ কমিশনারের পদ থেকে সরতেই হবে বিনীত গোয়েলকে।’’
অগস্ট গড়িয়ে সেপ্টেম্বর। গত প্রায় এক মাসে আরজি করের চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুনের বিচারের দাবিতে আন্দোলনের আঁচ একটুও কমেনি। বরং ঝাঁজ দিন দিন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্রুত বিচারের দাবিতে পথের দাবি জারি রয়েছে। সেই প্রতিবাদে রাজনৈতিক দলগুলি যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে আমজনতা। দ্বিতীয় পক্ষই বেশি।
সোমবার দুপুর হতেই লালবাজার অভিযান শুরু করেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। হাতে গোলাপ নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল শুরু করেন তাঁরা। বিনীতকে গোলাপ দিয়ে কলকাতা পুলিশ কমিশনারের পদ থেকে ‘বিদায়’ জানাতে চেয়েছিলেন আন্দোলকারীরা। জুনিয়র চিকিৎসকদের তরফে জানানো হয়েছে, কোনও সংঘাতের মাধ্যমে নয়, শান্তিপূর্ণ ভাবে পুলিশ কমিশনারের অপসারণ বা পদত্যাগ চান তাঁরা। তাই প্রতীকী মেরুদণ্ড আর গোলাপ নিয়ে অভিযান জারি ছিল দুপুর ২টো থেকে। রাত আড়াইটের পরেও লালবাজারের পথে রাত জাগছেন চিকিৎসকেরা।
সন্দীপ ঘোষের গ্রেফতারি নিয়ে আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, এটা সার্বিক আন্দোলনেরই জয়। তবে এখনই আন্দোলন থামছে না। আন্দোলনকারী চিকিৎসক অনিকেত মাহাতো বললেন, ‘‘সকল আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীকে কুর্নিশ। তবে সন্দীপ স্যর গ্রেফতার হলেও আন্দোলন চলছে এবং চলবে।’’ এমনকি, পুলিশকে আশ্বাসের সুরে আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, ‘‘আমরা দায়িত্ব নিয়ে বলছি, কোথাও কোনও অশান্তি হবে না। কোথাও বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তৈরি হবে না।’’
গত ৯ অগস্ট আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে এক মহিলা চিকিৎসক পড়ুয়ার ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার পর থেকেই তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে নানা মহলে। তদন্তভার হাতে পাওয়ার পর গত ১৫ অগস্ট তাঁকে প্রথম বার তলব করেছিল সিবিআই। সেই দিন হাজিরা দেননি সন্দীপ। পর দিন অবশ্য সল্টলেকের রাস্তা থেকে সিবিআইয়ের গাড়িতে ওঠেন। তার পর থেকে ২৪ অগস্ট পর্যন্ত টানা ৯ দিন তাঁকে তলব করা হয় সিজিওতে। দৈনিক ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টা পর্যন্ত সিবিআই দফতরে থাকতে হয়েছিল সন্দীপকে। পরে আবারও তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়। অবশেষে সোমবার তিনি গ্রেফতার হন আরজি কর হাসপাতালের আর্থিক দুর্নীতি মামলায়। সন্দীপের সঙ্গে সঙ্গে আরও তিন জন গ্রেফতার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে এক জন হাওড়ার সাঁকরাইলের বাসিন্দা বিপ্লব সিংহ। তাঁর সংস্থা ‘মা তারা ট্রেডার্স’ হাসপাতালে চিকিৎসার সরঞ্জাম সরবরাহ করত। গত সপ্তাহে সাঁকরাইলে বিপ্লবের বাড়ি এবং সংস্থার অফিসে হানা দিয়েছিল সিবিআই। সোমবার তাঁকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে খবর, বিপ্লবের বাবা কলকাতার একটি মেডিক্যাল কলেজে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন। বিপ্লব আঁকাআঁকি করতেন। সেই সূত্রে হাসপাতালে টিনের প্লেটে নম্বর লেখা কিংবা বেড নম্বর লেখার বরাত পেতেন। ওই কাজ করতে করতে চিকিৎসার সরঞ্জাম সরবরাহের ব্যবসা শুরু করেন বিপ্লব। দুর্নীতি মামলার তদন্তে ‘হাজরা মেডিক্যাল শপ’ নামে একটি ওষুধের দোকানে হানা দিয়েছিল সিবিআই। ওই দোকানের মালিক সুমন হাজরাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতদের মধ্যে রয়েছেন আফসার আলি। তিনি সন্দীপের নিরাপত্তারক্ষী। অভিযোগ, ধৃত তিন জনকে বেআইনি ভাবে হাসপাতালে ক্যাফেটেরিয়া, পার্কিং লট-সহ নানা সুবিধা পাইয়ে দিয়েছিলেন সন্দীপ।
অন্য দিকে, কলকাতা শহরে রাত বেড়েছে। পুলিশের বড়কর্তারা ফিরেছেন। পথে রয়ে গিয়েছেন বাকি পুলিশকর্মীরা। আর ব্যারিকেডের এ পারে ওঁরা। যে ব্যরিকেডের দিকে তাকিয়ে চিকিৎসক অনিকেত মাহাতো সন্ধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘আমরা তো বসেই থাকব। বসেই থাকব। উনি (কলকাতা পুলিশ কমিশনার) আসুন। জাস্ট (শুধু) ওঁর হাতে ডেপুটেশনটা দেব। না হলে ব্যারিকেড তুলে দেওয়া হোক। আমাদের বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট পর্যন্ত যেতে দেওয়া হোক।’’
সে দাবি মানা হয়নি। পুলিশ জানিয়েছিল, মানা সম্ভব নয়। আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি দলকে লালবাজারে যাওয়ার অনুরোধ করা হয় পুলিশের তরফে। কিন্তু সে অনুরোধে কান দেননি জুনিয়র ডাক্তাররা। তাঁদের দাবি মেনে ব্যারিকেড তোলা হয়নি। ফিয়ার্স লেন পেরিয়ে লালবাজারের দিকে এক পা-ও এগোতে দেওয়া হয়নি মিছিল।
ফলে রাত আড়াইটেতেও সেই ব্যারিকেডের দিকে তাকিয়েই বসে আছেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। নিজেদের দাবিতে অনড় এবং নাছোড় মনোভাব নিয়ে লালবাজারের কাছেই তাঁরা রাত জাগছেন।