রেপ-তদন্ত ৩৬ দিনে, সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসিই! বিল পেশ বিধানসভায়
এই সময় | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
এই সময়: আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ-খুনের ঘটনার পরেই ধর্ষণ রুখতে কঠোর আইন করার কথা ঘোষণা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তি ছিল, ধর্ষণের মামলায় দ্রুত তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে দ্রুত মৃত্যুদণ্ডের সাজা নিশ্চিত করতেই কঠোর আইন প্রয়োজন।দেশজুড়ে ধর্ষণের ঘটনা বন্ধ করতে কঠোরতর কেন্দ্রীয় আইন তৈরির জন্যও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে দু’বার চিঠি দিয়েছেন মমতা। তারপরেও নতুন কঠোর আইন তৈরি নিয়ে কেন্দ্র কোনও আশ্বাস দেয়নি। এই প্রেক্ষাপটে ধর্ষণের ঘটনায় অপরাধীর দ্রুত মৃত্যুদণ্ডের সাজা নিশ্চিত করতে বিধানসভায় সোমবার ‘দ্য অপরাজিতা উওম্যান অ্যান্ড চাইল্ড বিল-২০২৪’ পেশ করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল সরকার।
এই বিলে যে কোনও ধর্ষণ বা গণধর্ষণের ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। ধর্ষণ ছাড়াও মেয়েদের উপরে অ্যাসিড হানার ক্ষেত্রেও যাবজ্জীবন শাস্তির উল্লেখ রয়েছে। অপরাধীকে দ্রুত শাস্তি দেওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি বিচার শেষ করতে বিশেষ আদালত গঠনের প্রস্তাবও আছে বিলে।
ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের তদন্ত সর্বোচ্চ ৩৬ দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ করার সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সার্বিক ভাবে নারী নিগ্রহের মোকাবিলায় ‘অপরাজিতা টাস্ক ফোর্স’ তৈরির প্রস্তাবও রয়েছে এই বিলে। আজ, মঙ্গলবার বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এই বিল নিয়ে আলোচনা হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই এই বিতর্কে অংশগ্রহণ করবেন বলে তৃণমূলের পরিষদীয় দল সূত্রের খবর।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে কঠোর আইনের পক্ষে এ দিন ফের সওয়াল করেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার রাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি লেখেন, ‘এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে গঠনমূলক পদক্ষেপের প্রয়োজন। অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য বাংলায় আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। টাইম বাউন্ড অ্যান্টি-রেপ আইন যাতে রাজ্যগুলি এবং কেন্দ্রীয় সরকার তৈরি করে, তার জন্য আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’
রাজ্য সরকার যে নতুন বিল নিয়ে এসেছে, বিধানসভায় শাসক দলের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় তা পাশ করানো সমস্যা হবে না। তবে আইনজ্ঞদের বক্তব্য, যে হেতু ধর্ষণ নিয়ে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার বিভিন্ন ধারা সংশোধনের জন্য এই বিল আনা হয়েছে, তাই বিধানসভায় বিল পাশ হওয়ার পর তা রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর অনুমোদনের জন্য পাঠাতে হবে।
রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিলে তবেই তা আইনে পরিণত হবে। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের ঘটনার প্রেক্ষাপটে রাজ্য সরকার এই ‘অপরাজিতা বিল’ বিধানসভায় পেশ করলেও তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের ঘটনার বিচার এই আইনে হবে না। এই মামলার বিচার ভারতীয় ন্যায় সংহিতা অনুযায়ীই হবে।
রাষ্ট্রপতি ‘অপরাজিতা বিল’-এ অনুমোদন দিলে তার পরবর্তী সময়ে যদি রাজ্যে কোনও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, তখন সে ক্ষেত্রে নতুন আইনে অপরাধীর বিচার হবে। ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন পড়ে থাকলে নির্যাতিতা বা তাঁর পরিবারের যন্ত্রণা অনেকগুণ বেড়ে যায়— এ কথা অনেক বার বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে গত শনিবার মুখ খুলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। তিনি বলেছিলেন, ‘মহিলাদের সুরক্ষার স্বার্থেই এই ধরনের অপরাধের দ্রুত বিচার হওয়া প্রয়োজন।’ রবিবার একটি অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুও মন্তব্য করেন, ‘যখন কেউ শেষ পর্যন্ত ন্যায়বিচার পান, তখন হয়তো তাঁর মুখের হাসিটাই হারিয়ে গিয়েছে।
অথবা তিনি হয়তো বেঁচেই নেই। আমাদের এই বিষয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করতে হবে।’ তবে এসবের পরেও কেন্দ্রের এনডিএ সরকার যে ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় ধর্ষণ সংক্রান্ত ধারা সংশোধন করবে, এমন কোনও ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি। কেন্দ্রের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী অন্নপূর্ণাদেবী পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন যে, ভারতীয় ন্যায় সংহিতার বর্তমান আইনেই কঠোর সাজা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে বিধানসভায় ‘অপরাজিতা বিল’ পেশ করে তৃণমূল সরকার যে কঠোর আইন প্রণয়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সেই বার্তা দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই বিল নিয়ে রাজ্যের পরিষদীয় মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী দ্রুত বিচার চাইছেন। মৃত্যুদণ্ড চাইছেন। আন্দোলনকারীরাও অপরাধীর কঠোর শাস্তি চাইছেন। সেই লক্ষ্যেই এই বিল পেশ করা হয়েছে।’
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অবশ্য এ দিন এই প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। আজ বিধানসভায় বিল নিয়ে বিতর্কে শুভেন্দু বিজেপির অবস্থান স্পষ্ট করবেন। ‘অপরাজিতা বিল’-এ ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় একমাত্র শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা হয়েছে। কলকাতা হাইকোর্টের প্রবীণ আইনজীবী পার্থসারথি সেনগুপ্তর পর্যবেক্ষণ, ‘বিরলতম ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু কোনও অপরাধের একমাত্র সাজা মৃত্যুদণ্ড, আর কোনও সাজা নেই— এটা সংবিধানের স্পিরিটের সঙ্গে খাপ খায় না। এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ও রয়েছে।’
কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি দেবাশিস করগুপ্তর কথায়, ‘সংবিধানের যৌথ তালিকাভুক্ত কোনও বিষয়ে রাজ্য সরকারের তৈরি করা বিলে যদি কোনও ধোঁয়াশা থাকে, রাষ্ট্রপতি তাহলে সুপ্রিম কোর্টের কাছে এই বিষয়ে পরামর্শ চাইতে পারেন। সুপ্রিম কোর্ট তখন সংশ্লিষ্ট বিলটির বিচার-বিশ্লেষণ করে তাদের মতামত রাষ্ট্রপতিকে জানাবে।’
বর্তমানে ন্যায় সংহিতায় খুনের ঘটনায় শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন সাজা রয়েছে। কিন্তু রাজ্যের এই নতুন বিলে যে কোনও ধর্ষণের ঘটনাতেই সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের সাজার প্রস্তাব রয়েছে। এই বিল অনুযায়ী প্রতিটি জেলায় ডিএসপি পদমর্যাদার অফিসারের নেতৃত্বে ‘অপরাজিতা টাস্ক ফোর্স’ তৈরি হবে। নারী নিগ্রহের অভিযোগের তদন্ত করবেন মহিলা অফিসার।
তদন্ত প্রক্রিয়ায় কোনও অফিসারের গাফিলতি দেখা গেলে তিনিও শাস্তির মুখে পড়বেন। পাশাপাশি ধর্ষণের ঘটনায় ট্রায়াল সম্পূর্ণ করতে যে বিশেষ আদালত গঠন হবে, সেখানে সেশন জাজ অথবা অ্যাডিশনাল সেশন জাজ মর্যাদার বিচারক থাকবেন। এই আদালতে যে সরকারি আইনজীবী থাকবেন, তাঁর অন্তত সাত বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।