এই সময়: কলকাতার পুলিশ কমিশনারের ইস্তফার দাবিতে জুনিয়র ডাক্তারদের 'লালবাজার অভিযান' কর্মসূচির মিছিল শেষ হলো লালবাজার থেকে ৫০০ মিটার দূরে, ফিয়ার্স লেনে রাতভর অবস্থান-বিক্ষোভে। তবে সোমবার আগাগোড়া জুনিয়র ডাক্তাররা সতর্ক ছিলেন অবাঞ্ছিত অশান্তি এড়ানোর ব্যাপারে। তাই, বহিরাগতদের আটকাতে মানব-বন্ধনও করেন তাঁরা।প্রতিবাদী জুনিয়র ডাক্তারদের হাতে ছিল মেরুদণ্ডের ডাক্তারি মডেল, বুকে গোলাপফুল আর মাথায় ছিল 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস' লেখা কালো ফেটি। এই ভাবেই জুনিয়র ডাক্তাররা কলকাতার সিপি বিনীত গোয়েলের পদত্যাগের দাবিতে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি মেনে সোমবার কলেজ স্কোয়্যার থেকে লালবাজার বিরাট মিছিল করলেন।
তাঁদের দাবি, ৯ অগস্ট ভোরে আরজি করে তরুণী চিকিৎসকের খুন-ধর্ষণের ঘটনার পর তদন্তে অপদার্থতা এবং ১৪ অগস্ট মধ্যরাতে আরজি করের ক্যাজ়ুয়াল্টি ব্লকে বেনজির হামলা ঠেকাতে পুলিশি ব্যর্থতার কারণেই তাঁরা সিপি-র পদত্যাগ চাইছেন। এ দিন সন্ধ্যায় তমলুকের বিজেপি সাংসদ, প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ফিয়ার্স লেনে জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থানের জায়গায় পৌঁছলে তাঁর উদ্দেশে 'গো ব্যাক' স্লোগান দেন বিক্ষোভকারীরা। তাঁরা চলে যেতে বলেন সাংসদকে।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই অভিজিৎ ওই জায়গা ছাড়েন। তবে হাজার ছয়েকের মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন সিনিয়র ডাক্তারদের পাশাপাশি বহু সাধারণ মানুষও। যদিও মিছিল লালবাজার পর্যন্ত পৌঁছয়নি। কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তর থেকে প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট ও ফিয়ার্স লেনের মোড়েই বিশাল ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেওয়া হয় মিছিল।
সেখানে আন্দোলনকারীরা রাস্তায় বসে পড়েন বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট ক্রসিং পর্যন্ত মিছিল আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবিতে। জুনিয়র ডাক্তারদের ২০ জনের প্রতিনিধিদলের লালবাজারে ঢুকে দাবিপত্র পেশ করার কথা থাকলেও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে আন্দোলনকারীরা দাবি করেন, দাবিপত্র হাতে নিতে ওই ফিয়ার্স লেন ক্রসিংয়েই আসতে হবে সিপি-কে। ঘণ্টা চারেক অবস্থানের পর কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (৫) অশেষ বিশ্বাস এবং ডেপুটি কমিশনার (সেন্ট্রাল) ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় কথা বলতে আসেন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে।
জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধিদলকে লালবাজারে আসতে বলেন ওই দুই আইপিএস অফিসার। কিন্তু সেই প্রস্তাবে আমল দেননি জুনিয়র ডাক্তাররা। তাঁরা দাবি জানান, হয় যত দূর মিছিল করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল (বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট), সেই পর্যন্তই যেতে দিতে হবে, অথবা ওই ফিয়ার্স লেনের মোড়ে আসতে হবে খোদ পুলিশ কমিশনারকে।
প্রতিবাদী জুনিয়র ডাক্তারদের স্পষ্ট বক্তব্য, '৩৬ ঘণ্টা ডিউটি করতে আমরা অভ্যস্ত। রাত জাগতে সমস্যা নেই। যতক্ষণ না পুলিশ দাবি মানছে, এক পা-ও নড়ব না এখান থেকে।' পুলিশ কমিশনারের কুশপুতুলও দাহ করা হয় সেখানে। এ দিন গোড়া থেকেই প্রবল পুলিশ-বিরোধী স্লোগানে মুখরিত ছিল মিছিল। 'প্রমাণ লোপাটে দায় কার, জবাব চাইতে লালবাজার' কিংবা 'পুলিশ তোমার এ কী হলো, কথায় কথায় মিথ্যে বলো' অথবা 'ডাক্তাররা নেমেছে পথে, পুলিশ তুমি হুঁশিয়ার' কিংবা 'ছিনিয়ে নিতে ন্যায়বিচার, গোলাপ হাতে লালবাজার' স্লোগান মুহুর্মুহু ছিল আগাগোড়াই।
প্রবল পুলিশ-বিরোধী স্লোগান বাদ দিলে পুরো মিছিলই ছিল একেবারে শান্তিপূর্ণ। কেন জুনিয়র ডাক্তাররা এমন পথে হাঁটতে বাধ্য হলেন, সাধারণ মানুষকে সে কথা বোঝাতে মিছিল থেকে লিফলেট বিলিও করা হয়। যেখানে উল্লেখ করা মূল পাঁচটি দাবির মধ্যে প্রধান ছিল সন্দীপ ঘোষের সাসপেনশন এবং পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগ।
সিবিআইয়ের হাতে এ দিন সন্ধ্যায় সন্দীপের গ্রেপ্তারির খবর মিলতেই ফিয়ার্স লেনে অবস্থানরত আন্দোলনকারীরা উচ্ছ্বাস-উল্লাসে ফেটে পড়েন। তাঁরা বলেন, 'এই গ্রেপ্তারি আমাদের নৈতিক জয়। স্বাস্থ্য ভবন যা পারেনি, সিবিআই তা করে দেখাল।' তবে সন্দীপের গ্রেপ্তারির পরেও পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগের দাবি থেকে চিকিৎসকরা এত টুকু সরেননি।
আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের নেতৃত্বে থাকা অনিকেত মাহাতো বলেন, 'গণতান্ত্রিক দেশে যেমন সকলের মিছিল, মিটিং, আন্দোলনের অধিকার আছে, পুলিশেরও তেমন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব আছে। কিন্তু সেই দায়িত্ব পালনে পুলিশ ব্যর্থ। না-হলে আরজি করে খুন-ধর্ষণের ঘটনায় তথ্যপ্রমাণ লোপাট হতো না, রাতে ইমার্জেন্সি ভাঙচুরও হতো না।'
অনিকেতের কথায়, 'পুলিশকে সেই দায়িত্ব মনে করাতেই আমরা লালবাজার অভিযান করছি। আর এই সব ব্যর্থতার দায় নিয়ে সিপি-র ইস্তফার দাবি তুলছি।' একদিকে লালবাজার অভিযান চললেও তার পাশাপাশি আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তাররা হাসপাতাল চত্বরে টেলিমেডিসিন ক্লিনিক চালাতে কিন্তু ভোলেননি।
সেখানে এ দিনও শ'চারেক রোগী পরিষেবা পেয়েছেন। স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রে খবর, কর্মবিরতি চলার মধ্যেই জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশ ধীরে ধীরে কাজে যোগ দিচ্ছেন পরিস্থিতি বুঝে। জুনিয়র ডাক্তারদের মূল দাবিগুলোর অন্যতম হলো, হাসপাতালে চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা।
সেই প্রসঙ্গে এ দিন রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা কৌস্তভ নায়েক বলেন, 'মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোয় মহিলাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে ১৫০০ প্রাক্তন সেনা এবং পুলিশকর্মী নিয়োগ করা হবে। তাঁদের বেশিরভাগই মহিলা। মহিলা চিকিৎসক ও নার্সদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই এই পদক্ষেপ।'