এই সময়, কলকাতা ও বর্ধমান: তাঁর বিরুদ্ধে নানা স্তরে অভিযোগ জমা হচ্ছিল বিস্তর। অন্যায় ভাবে সরকারি সুযোগ-সুবিধে পাওয়া থেকে শুরু করে আরজি করের ঘটনা নিয়ে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে পড়ুয়াদের একাংশকে পরোক্ষে শাসানি— তালিকায় রয়েছে সব কিছুই। এই পরিস্থিতিতে সোমবার রাতে এসএসকেএমের পিজিটি অভীক দে-কে দল থেকে সাসপেন্ড করল তৃণমূল ছাত্র পরিষদ।তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগের নিষ্পত্তি না-হওয়া পর্যন্ত এই সাসপেনশন বহাল থাকবে বলে সংগঠনের তরফে জানানো হয়েছে। গত ৯ অগস্ট তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের রাতে আরজি কর হাসপাতালের সেমিনার রুমে লাল জামা পরে কে ছিলেন? কেন ছিলেন? কীসের এক্তিয়ারে? আচমকা ভেসে ওঠা একটি ভিডিয়োয় এ ভাবেই সামনে আসে অভীকের কীর্তিকলাপ।
ভিডিয়ো প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই গা-ঢাকা দিয়েছেন যিনি। কিন্তু সোমবার জানা গেল, আরজি করে ঘটনার রাতেই শুধু নয়, তার দু’দিন পর (১১ অগস্ট) বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজেও গিয়েছিলেন অভীক। সে দিন রাত ১১টায় পড়ুয়াদের একাংশকে নিয়ে লেকচার থিয়েটারে যান এবং তাঁদের উদ্দেশে প্রায় শাসানির সুরে বলেন, ‘৯ তারিখ আমি আরজি করে ছিলাম। সিসিটিভি ক্যামেরার সমস্ত ফুটেজ দেখেছি। তোদের যা প্রশ্ন আছে কর। তবে মনে রাখবি, আমি যেমনটা বলব, তেমনই পরে তোদের করতে হবে। কেউ বাড়াবাড়ি করবি না।’
সোমবার অভীকের বিরুদ্ধে এমনই নানা অভিযোগ করেন বর্ধমান মেডিক্যালের জুনিয়র ও সিনিয়র চিকিৎসক-পড়ুয়ারা। তাঁদের দাবি, ১১ রাতে অভীকের আসার ভিডিয়ো ফুটেজ প্রকাশ করতে হবে। এসএসকেএমের সার্জারি বিভাগের স্নাতকোত্তর প্রথম বর্ষের চিকিৎসক-পড়ুয়া বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে এমন প্রভাবশালী হলেন কী করে, সেটাই এখন অনেকের প্রশ্ন।
আগে বর্ধমান মেডিক্যালের রেডিওলজি বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন তিনি। বাড়ি বর্ধমান শহরেই। অভিযোগ, এসএসকেএমে যাওয়ার পরেও তাঁর প্রভাব একইরকম রয়েছে বর্ধমান মেডিক্যালে। সম্প্রতি কলেজের গেস্ট হাউসের একটি রুমে অভীকের জন্মদিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে ছিলেন কলেজের অধ্যক্ষা মৌসুমি বন্দ্যোপাধ্যায়, এমএসভিপি তথা বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার তাপস ঘোষও।
কী হয়েছিল ১১ অগস্ট?
এ দিন সাংবাদিক বৈঠকে পড়ুয়াদের তরফে কলেজের পিজিটি গৌরাঙ্গ প্রামাণিক বলেন, ‘১১ তারিখ ১১টার সময়ে লেকচার থিয়েটার হল খুলিয়ে ছাত্রছাত্রীদের হাজির করান অভীক। সেখানে তিনি কোনও রাখঢাক না-রেখেই জানান, তিনি ৯ অগস্ট আরজি করের সেই সেমিনার হলে ছিলেন। অভীক দাবি করেন, তরুণী চিকিৎসককে যে ধর্ষণ করা হয়েছে তা ময়না-তদন্তের রিপোর্ট ছাড়া বলা যাবে না। এ নিয়ে কিছু বলতে নিষেধ করেন ছাত্রছাত্রীদের। এ নিয়ে আমাদের কাছে একটি অডিয়ো ফুটেজও রয়েছে।’
গৌরাঙ্গ বলেন, ‘অভীক যাতে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে আর ঢুকতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। মার খাওয়ার আগে ভয় লাগে, মার খেলে আর ভয় লাগে না। আমাদের ভয় কেটে গিয়েছে।’ আর এক চিকিৎসক-পড়ুয়া সাহারাত হোসেনের বক্তব্য, ‘সে দিন রাতে প্রায় ১২টা পর্যন্ত মিটিং করে অভীক এটাই বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, আরজি কর নিয়ে আমরা যেন কোনও আন্দোলন না করি। এ-ও বলেন, যে হেডফোনের সূত্রে সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সে বিষয়টিও তিনি জানতেন। এমনকী পুলিশ ধৃতকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময়েও নাকি তিনি সেখানে ছিলেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রী বলেন, ‘অভীক দে কী ভাবে আমাদের দিনের পর দিন মানসিক ভাবে নির্যাতন করেছেন, সেটা আমরা ছাড়া কেউ জানে না। নিজেকে অঘোষিত স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলে মনে করতেন। ওঁর ইচ্ছামতো মেডিক্যাল কলেজ পরিচালিত হতো। কেউ কিছু বলতে পারতেন না।’
দ্বিতীয় বর্ষের এক পিজিটি বলেন, ‘কী পরিমাণে ঠান্ডা মাথায় থ্রেট দিতেন অভীক, সেটা না শুনলে বুঝতে পারবেন না। ১১ তারিখ রাতেও তো সেটাই করলেন।’ এ বিষয়ে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষা মৌসুমি বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘পরে ফোন করছি। কলেজে আছি এখন।’ পরে অবশ্য আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।