• অনাহার থেকে মুক্তি খুঁজছে হাড়জোড়া
    বর্তমান | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • পিনাকী ধোলে, হাড়জোড়া (বলরামপুর): সালটা ২০০৪। ঝাড়গ্রামের আদিবাসী অধ্যুষিত বেলপাহাড়ির আমলাশোলে অনাহারে মৃত্যুর অভিযোগে তোলপাড় হয়েছিল রাজ্য-রাজনীতি। দু’দশক পর আমলাশোলের সেই স্মৃতি যেন উস্কে দিল পুরুলিয়ার বলরামপুরের হাড়জোড়া গ্রাম। ভাগ্যিস, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চালু করেছিলেন ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচি! তা না হলে অনাহারে মৃত্যু-মিছিল...পিঁপড়ের ডিম খাওয়ার মতো হাল হতো হাড়জোড়ার। হয়তো হয়ে উঠত রাজ্যের দ্বিতীয় ‘আমলাশোল’। ‘দুয়ারে সরকার’-এর হাত ধরে সেটা আর হয়ে ওঠেনি বলরামপুরের শবর অধ্যুষিত এই অজ গাঁ। দীর্ঘদিন রাজনৈতিক অবহেলা, বঞ্চনার শিকার ছিলেন শবররা। পাচ্ছিলেন না আধার কার্ড, ভোটার কার্ড। এমনকী, জন্মের শংসাপত্রও জোটেনি কারও কপালে। এতদিন তাঁরা জেনে এসেছেন এটাই স্বাভাবিক! এখন ‘দুয়ারে সরকার’ শিবির তাঁদের চোখ খুলে দিয়েছে। জেলা প্রশাসনের আশ্বাস আঁক‌঩ড়ে অর্ধাহার, অনাহারের হাত থেকে এবার মুক্তি চাইছেন হা‌ড়঩জোড়ার শবরবাসী।  

    পুরুলিয়া শহর থেকে বলরামপুর যাওয়ার পথেই পড়ে উরমা হাটতলা। সেখান থেকে মেরেকেটে পাঁচ কিলোমিটার গেলেই হাড়জোড়া। বাম আমলের মেঠো পথ, এখন ঢালাই। রাস্তার দু’পাশে সবুজ বনানী। কাশ ফুলের কোলাকুলি। আগমনীর বার্তা আকাশে-বাতাসে। গ্রামের শেষ প্রান্তে দিগন্তের কোলেই বাস ৩২টি শবর পরিবারের। দূরে উঁকি মারে দলমা পাহাড়। গ্রামের চেহারাখানি পটে আঁকা ছবির মতো। কিন্তু ক্ষুধার রাজ্যে গুরুচরণ শবর, দেবী শবর, বাসন্তী শবরদের কাছে গোটা পৃথিবীটাই যেন গদ্যময়! থালায় ছড়ানো এক মুঠো শুকনো ভাতে ভাগ বসায় পোষ্য হাঁস-মুরগিরাও। কোনও রাতে খাবার জোটে। কোনও রাতে জোটে না। জুটলেও আধপেটা। ওঁরা বিনামূল্যে রেশন পান না। সরকারি কোনও ভাতা পান না। অথচ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সামাজিক সুরক্ষার একাধিক প্রকল্প প্রদান করে চলেছে। তা হলে কেন দেবী-বাসন্তীরা সেই সুবিধা পান না?  

    সবার বাড়িতে ঢুঁ মারলেই বোঝা যায়, স্বাধীন ভারতের মধ্যে যেন একখণ্ড ‘পরাধীন ভারত’ হাড়জোড়া গ্রামের এই শবরপাড়া। বহু মানুষের নেই কোনও জন্মের শংসাপত্র। নেই আধার কার্ড, নেই অনেকের সচিত্র ভোটার কার্ডও।  আধার ছাড়া আঁধারে সকলেই! তবে, দুয়ারে সরকার কর্মসূচির সময় ওই গ্রামে গিয়ে বিষয়টি নজরে আসে পুরুলিয়া মহকুমা শাসক উৎপল ঘোষ, ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক সৌগত চৌধুরীর। তারপর থেকেই জরুরি ভিত্তিতে বাসিন্দাদের জন্মের শংসাপত্র তৈরি করে দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়। কিছুদিনের মধ্যে আধার কার্ড হয়ে গেলেই সমস্ত সরকারি সুযোগ মিলবে বলে আশ্বাস প্রশাসনের। শবরপাড়ায় ৩২টি পরিবার মিলিয়ে মোট ১৪২ জনের বসবাস। প্রায় সকলেই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, বার্ধক্য ভাতা থেকে শুরু করে সমস্ত সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ছেলেমেয়েরা ভর্তি হতে পারছে না স্কুলে। গুরুচরণ শবর বলছিলেন, ‘আমার পরিবারের মোট সাতজন সদস্য। রয়েছে একটি রেশন কার্ড। তাতে যা চাল পাই সাতটা পেট চলে না।’ 

    গ্রামে নেই নূন্যতম স্বাস্থ্য পরিষেবাটুকুও! গত কয়েক মাসের মধ্যে বিভিন্ন রোগে মৃত্যু হয়েছে ছ’জন বাসিন্দার। এখনও গুরুতর অসুস্থ হয়ে ধুঁকছেন দু’জন। চিকিৎসকদের মতে, পুষ্টির অভাব থাকলে একাধিক রোগ ভোগের সম্ভাবনাই বেশি। প্রশাসনের আধিকারিকরাও মানছেন, গ্রামের পুরুষরা কেউ ৬০ বছর পর্যন্ত বাঁচেন না! 

    লোকসভা ভোটের আগে পুরুলিয়া জেলাজুড়ে ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচি হয়। তখন প্রত্যন্ত এলাকা পরিদর্শনে বেরিয়েছিলেন এসডিও, বিডিওরা। আর তখনই হাড়জোড়ার শবরপাড়ার দুর্দশার বারমাস্যা নজরে আসে তাঁদের। পুরুলিয়ার মহকুমা শাসক উৎপল ঘোষ বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরে আসার পরেই যাঁদের জন্মের শংসাপত্র নেই, তাঁদের চিহ্নিত করি। প্রায় ৫০ জনের জন্মের শংসাপত্র তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।’ বিডিও সৌগত চৌধুরী বলেন, ‘এবার প্রত্যেকের আধার কার্ড করে দেওয়া হবে। আশা করছি আগামী এক মাসের মধ্যে সবাই আধার কার্ড পেয়ে যাবেন।’ সেই আশায় আঁধার ভুবনে আলোর খোঁজে বাসন্তীরা...। 
  • Link to this news (বর্তমান)