• হারিয়ে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গের বিষহরা গান, মন খারাপ শিল্পীদের
    বর্তমান | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • নিজস্ব প্রতিনিধি, জলপাইগুড়ি: কারও বয়স সত্তর পার করেছে। কেউ আবার আশির দোরগোড়ায়। সন্ধ্যা হলেই তাঁরা মিলিত হন জলপাইগুড়ির পাহাড়পুর মোড়ে শিবমন্দিরে। মন্দিরের চাতালেই কম উজ্জ্বল আলোয় শুরু হয় বিষহরা গান। একটা মাইকের ব্যবস্থা করা হয়েছে বটে, যাতে দূর থেকে শোনা যায়। কিন্তু দর্শক-শ্রোতা হয় না। ফলে কিছুক্ষণ পর পালা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন গিদাল (মূল গায়ক)।

    কিন্তু এভাবে আর কতদিন? প্রশ্ন ৭৩ বছরের গিদাল বীরেশ্বর রায়ের। বললেন, নতুন প্রজন্ম পুরোপুরি বিমুখ। আগে তাও কিছু বাড়ির মহিলা আসতেন পালা শুনতে। তাঁরাও এখন সন্ধ্যা হলেই টিভি সিরিয়ালে মজে থাকেন। কখনও সখনও আমাদের মতো হাতেগোনা কয়েকজন প্রবীণ মানুষ আসেন। তাঁদের জন্যই টিকিয়ে রাখা। পালা শেষ করে মুখা বাঁশি, কুশান, দোতারা গোছাচ্ছিলেন উপেন বসাক। বললেন, একটা সময় ছিল যখন উত্তরবঙ্গে রাজবংশী সমাজে যে কোনও শুভ অনুষ্ঠানে আমাদের ডাক পড়ত। বিষহরা গান হতো। এখন তো বিয়েবাড়ি মানেই ডিজে, জলসা। পদ্মপুরাণ বা মনসামঙ্গল শোনার উৎসাহ কার আছে?

    উত্তরে বিষহরা পালাগানের যে ক’জন আদি শিল্পী টিকে আছেন, তাঁদের বেশিরভাগই জলপাইগুড়ির পাহাড়পুরের। এখানে গোটা ত্রিশেক পরিবারের প্রবীণরা গিদাল। সারাবছর অপেক্ষা করে ডাক আসে জলপাইগুড়ি রাজবাড়ি থেকে। পাহাড়পুরের গিদালরা রাজবাড়ির মনসাপুজোয় ৫১৫ বছর ধরে বংশপরম্পরায় বিষহরা গান গেয়ে আসছেন। ওটুকুই যা প্রাপ্তি। বছরের বাকি সময় বায়নার অপেক্ষায় থাকতে হয়। এতে রোজগার নিয়ে যতটা না চিন্তিত শিল্পীরা, তার চেয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন উত্তরে একসময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় এই পালাগান হারিয়ে যেতে বসার কথা ভেবে।

    বীরেশ্বরবাবু বলেন, আমার ছেলে, ভাগ্নেদের পালা শেখানোর অনেক চেষ্টা করেছি। পারিনি। ভয় হয় আমি মারা গেলে পালাগানের আসরে গিদালের উত্তরসূরি কেউ থাকবে না। একই ভাবনা বিষহরা শিল্পী যতীশচন্দ্র রায়ের। বললেন, আমার তো চারটে ছেলে। একটাকেও পালার আসরে আনতে পারিনি।

    ক্ষিতীশচন্দ্র রায়, পলাশ রায়, সুজানু তন্ত্র, বিধান তন্ত্রের মতো শিল্পীদের আবার ক্ষোভ অন্য। বললেন, বিষহরা হল সুরের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে গাওয়া পালা। মূল উপজীব্য পদ্মপুরাণ বা মনসামঙ্গল। ইদানীং ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কয়েকটি দল তৈরি হয়েছে। তারা যাত্রার ঢংয়ে মঞ্চে রঙ্গতামাসা করছে। দলের মহিলারা মঞ্চে নাচছেন। এতে ভিড় হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বিষহরা পালা বিকৃত হচ্ছে। এটা ঠিক নয়।
  • Link to this news (বর্তমান)