• এক হও, বাড়াও হাত! বয়স ভুলেই প্রতিবাদ
    এই সময় | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউজ়ের সামনে তখন বিশাল জমায়েত। সেখানেই ছিলেন অশীতিপর শান্তিরাম মুখোপাধ্যায়। হাতে ছাতা, গলায় ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ লেখা প্ল্যাকার্ড। শান্তিরামকে মিছিলে দেখে হতবাক ষাট পেরোনো অনুপম সিনহা। মানিকতলায় তাঁরা প্রতিবেশী। অনুপম এগিয়ে গিয়ে শান্তিরামের হাত ধরে বললেন, ‘কাকু, তুমি এই রোদের মধ্যে মিছিলে এলে? কষ্ট হচ্ছে না? কতদিন তো পাড়াতেই বেরোও না।’শান্তিরামের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। অনুপমকে বলেন, ‘তোদের কাকিমা চলে যাওয়ার পর থেকে আমি আর বাড়ি থেকে তেমন বেরোই না। তোদের সঙ্গেও তাই দেখা হয় না। কিন্তু এমন ঘটনার পরও যদি বাড়ি থেকে না বেরোই, তা হলে ঈশ্বরের কাছে কী জবাব দেবো বল!’

    পরের ছবিটা অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের সামনে। জাস্টিসের দাবিতে সেখানে চলছে সভা। রূপান্তরকামী সমাজকর্মী অনুরাগ মৈত্রেয়ী বক্তব্য রাখছেন। নিয়ত শুধু মহিলাদেরই নয়, কী ভাবে সমাজের সবস্তরে সব জায়গায় মৈত্রেয়ীদেরও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়, সে সব বলছেন তিনি। বক্তব্য শেষ হলে এগিয়ে গেলেন এক প্রৌঢ় দম্পতি। মৈত্রেয়ীর হাত ধরে বললেন, ‘তোমাদের জীবনে যে এত কষ্ট, এত যন্ত্রণা, সেটা এখানে না এলে, তোমার কথা না শুনলে জানতে পারতাম না।’

    এই সে দিন কলেজ স্ট্রিট থেকে উত্তর কলকাতার ২০টি স্কুলের প্রাক্তনীদের মিছিলে দেখা গেল দুই বৃদ্ধাকে। মাথা ভর্তি পাকা চুল। বেশ গর্ব নিয়ে বললেন, ১৯৭৪-এ তখনও মাধ্যমিক শুরু হয়নি, আমরা স্কুল ফাইনাল পাশ করেছিলাম। দাঁতে দাঁত চিপে শ্যামবাজার পর্যন্ত হেঁটে চললেন।

    প্রতিবাদের খবর পেলেই শারীরিক দুর্বলতা উপেক্ষা করে সামিল হচ্ছেন যাদবপুরের বাসিন্দা, ৭০ ছুঁইছুঁই দীপান্বিতা পাল চৌধুরী। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা দীপান্বিতার মেয়ে থাকেন বিদেশে। দেড় বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পরে যাদবপুরের বাড়িতে একাই থাকেন। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া তেমন একটা বেরোন না।

    কিন্তু এখন তাঁর নিত্য রুটিনে ঢুকে পড়েছে মিছিল, মিটিং, জমায়েত। দীপান্বিতার কথায়, ‘নিজের মেয়ের কথা ভেবে রাস্তায় নামছি। ওই মেয়েটাও (নিহত চিকিৎসক) তো আমারই মেয়ে। কত নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে। সবারই তাগিদটা এক।’

    বন্ডেল গেটের বাসিন্দা, ৭২ বছরের শিবাজি গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী সৈয়দ মিনা মৌলারা যেমন মনে করেন, প্রতিবাদের সূত্র ধরেই বহু মানুষ বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পাচ্ছেন।

    যেন ‘একলা নয়, এটা এক হওয়ার সময়’। মিছিল হোক বা জমায়েত, রাত দখলের কর্মসূচি হোক বা দিন বদলের ডাক — হাতে হাতে যেন ব্যারিকেড গড়ছেন ওঁরা। আরজি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ, খুনের পর থেকে নজিরবিহীন নাগরিক মিছিল ও প্রতিবাদ-জমায়েতের সাক্ষী মহানগর। সেখানে হাজির বড় অংশই একে অন্যকে চেনেন না। কিন্তু প্রতিবাদের ঢেউ তাঁদের এক করেছে।

    শান্তিরামের মতো বহু একলা মানুষ পথে নেমেছেন। মৈত্রেয়ীর মতো রূপান্তরকামীরাও আর তথাকথিত ‘প্রান্তিক’ হিসেবে গণ্য হচ্ছেন না। আসলে কেউ একা থাকেন, আর কাউকে কাউকে তো সমাজ একা করে দেয়। সেই ‘একা, একলা’ মানুষগুলোর একাকিত্ব কাটিয়ে ওঠার রসদ যেন জোগাচ্ছে এই প্রতিবাদ। ভাঙছে নানা সোশ্যাল ট্যাবুও।

    আরজি করের ঘটনায় বিচার চেয়ে পথে নামেননি, এমন পেশা আর প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়াই কঠিন। প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন যৌনকর্মীরাও। তাঁদের ডাকে মিছিলে যোগ দিয়েছেন বহু সাধারণ মানুষ। সোনাগাছির বাসিন্দা মহুয়ার (নাম পরিবর্তিত) কথায়, ‘একটা সময়ে আমাদের পুজোর অঞ্জলি দিতে দেওয়া হতো না। এর প্রতিবাদে আমরা মাটি দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আরজি করের ঘটনায় প্রতিবাদের সময়ে দেখছি এলাকার বহু সাধারণ মানুষ পাশে দাঁড়িয়েছেন। হাতে হাত রেখে মিছিল করছেন।’

    প্রায় প্রতিটি নাগরিক মিছিলেই স্লোগান তুলতে দেখা যাচ্ছে অনুরাগ মৈত্রেয়ীর মতো রূপান্তরকামীদের। গলা ভেঙে গিয়েছে তাঁর। তবু দৃপ্ত ভাবে মৈত্রেয়ী বলছেন, ‘সভায়, জমায়েতে কথা বলার পরে এমন সব মানুষের সঙ্গে প্রতিদিন আলাপ হচ্ছে, যাঁরা আমাদের অবস্থার কথা জানতেনই না। হয়তো কেউ কেউ উপেক্ষাও করেছেন। তাঁরাই এখন বলছেন, পাশে আছি। এত যন্ত্রণার মধ্যেও এটা এক রকমের প্রাপ্তি।’

    প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক সুকন্যা সর্বাধিকারীর কথায়, ‘গণচেতনা এ ভাবেই ছড়িয়ে পড়ে। এতে তাৎক্ষণিক ভাবে হলেও বেঁচে থাকার একটা বোধ তৈরি হয়। সেই বোধই এই মিছিলগুলোতে মানুষের ঢল নামাচ্ছে।’
  • Link to this news (এই সময়)