এই সময়: তখনও ভালো করে ফর্সা হয়নি আকাশ। রাতজাগা চোখে দুনিয়ার ক্লান্তি এসে জমা হয়েছিল ভোরে। তখনই জাতীয় সঙ্গীত! ব্যারিকেডের এ পাশে টানটান দাঁড়িয়ে গেয়ে উঠল অবস্থানে বসা হাজার কণ্ঠ। ‘জনগণমন অধিনায়ক’ শুনে অতীতে কখনও ঘুম ভেঙেছিল কি বউবাজারের? মনে করতে পারেন না স্থানীয়রা। অবস্থানরত চিকিৎসক এবং পুলিশকর্মীরাও।বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে ব্যারিকেডের ওপারে পাহারারত সাধারণ পুলিশকর্মীদের গায়ে-মুখে যে আলস্য এসে ভিড় করেছিল, জাতীয় সঙ্গীত শুনে ধড়মড় করে সে সব দূরে সরিয়ে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে যান তাঁরাও। ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিল অভূতপূর্ব এক দৃশ্য।
সোমবার ব্যতিক্রমী রাত রাস্তায় বসেই কেটেছিল কয়েকশো জুনিয়র ডাক্তারের। ব্যারিকেড আগলে পথে ছিলেন কয়েকশো পুলিশও। আর গোটা রাত অবস্থানের সঙ্গে থেকে নিজেদের সমর্থন জানিয়ে গেলেন স্থানীয়রাও। দিনের শুরুটাই যে শুধু ব্যতিক্রমী ছিল তেমনটা নয়, সোমবার রাতটাও হয়তো অনেকেই চিরকাল মনে রাখবেন। অনাত্মীয়, অপরিচিত কয়েক হাজার মানুষ এই রাতেই তো অদৃশ্য এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
‘কাছাকাছির মধ্যে ওয়াশরুম কোথায় আছে জানিস?’, উই ওয়ান্ট জাস্টিস স্লোগানের মাঝেই চাপা গলায় সহপাঠীকে প্রশ্ন এক তরুণীর। ‘ওই তো, সোজা চলে যা বেগ সাহাব রেস্তোরাঁয়।’ ‘একটা পাওয়ার ব্যাঙ্ক আছে কারও কাছে? আমার ফোনটায় একদম চার্জ নেই’, কিছুটা বিভ্রান্তই দেখালো তরুণকে। এ বারও আঙুল উঠে গেল সেই বেগ সাহাব রেস্তোরাঁর দিকেই।
ওই রেস্তোরাঁয় পর পর চারটে পয়েন্টে আইফোন-সহ সব রকমের ফোন চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সারা রাত রেস্তোরাঁ খোলা রেখে অবস্থানে বসা ছেলে মেয়েদের সব রকম আবদার হাসিমুখে সহ্য করেছেন মহম্মদ আমির বক্তিয়ার বেগ। মঙ্গলবার সকাল ৯টা নাগাদ কয়েক ঘণ্টার জন্য বাড়ি যাওয়ার সময়ে কর্মচারীদের প্রতি তাঁর কড়া নির্দেশ ছিল, রেস্তোরাঁর শৌচাগার ব্যবহার করতে চেয়ে অবস্থানের একজনকেও যাতে ফিরে যেতে না হয়।
অবস্থানে বসা এক তরুণী ‘এই সময়’-কে বলেন, ‘উনি না থাকলে খুব সমস্যায় পড়তাম আমরা। বায়ো টয়লেট এসেছিল মঙ্গলবার সকালে। কিন্তু, সোমবার সারা রাত আমাদের জন্য ওঁর রেস্তোরাঁর দরজা খোলা ছিল।’ মহম্মদ আমির বেগের কথায়, ‘আমি খুব সামান্য ভাবে হলেও এর অংশীদার হয়ে রইলাম। এটাই আমার পাওনা।’
আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছেন অভিনেতা সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়। জানালেন, সন্ধে থেকে অত ছেলে-মেয়েকে রাস্তায় বসে থাকতে দেখেন সাদ্দাম। পুলিশের তৈরি লোহার ব্যারিকেড ঘেঁষেই তাঁর বাড়ি। সোমবার রাতেই বার্তা পাঠান, তাঁর বাড়ির দুটো বাথরুম সারা রাত খুলে রাখছেন তিনি। একই ভাবে স্থানীয় বাসিন্দা শুভশ্রী মৈত্র সোমবার সারা রাত খুলে দিয়েছিলেন দরজা।
শুধু বাথরুম ব্যবহার নয়, রাতে চাইলে তাঁর ঘরে বিশ্রামও নেওয়া যাবে, জানিয়েছিলেন তিনি। সারারাত জেগে থাকা ক্লান্তি কাটাতে স্নান সেরে খাবারেরও ব্যবস্থা করেন তিনি। সৌম্য বলেন, ‘বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের এমন অনেক বাড়ি থেকে এ ভাবে এগিয়ে এসেছে সাহায্যের হাত। খোলা আকাশের নীচে কখনও অসহায় মনে হয়নি নিজেদের।’
রাত বাড়তেই আন্দোলনকারীদের জন্য নিজে স্যান্ডউইচ তৈরি করে এনেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা স্নিগ্ধা জৈন। কোথায় বাড়ি তাঁর? প্রশ্ন করায় জুনিয়র ডাক্তারদের সাফ জবাব, ‘সেটা জানাতে পারব না। প্রশাসনের প্রতি আমাদের আর একটুও আস্থা নেই। হয়তো আমাদের খাবার দিয়েছেন বলেই ওঁকে বিপদে ফেলা হবে।’ শুধু স্থানীয় কেন, অবস্থানের কথা শুনে বেলেঘাটা থেকে খাবারের প্যাকেট নিয়ে বউবাজারে হাজির হয়েছিলেন বিশ্বজিৎ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এটা তো আমার সামাজিক ধর্ম। সেটাই পালন করেছি।’
তালিকাটা দীর্ঘ। মঙ্গলবার সকালে কখনও এক ছা-পোষা চা-বিক্রেতাকে দেখা গিয়েছে সাধ্যমতো বেশ কিছু স্যান্ডউইচ বানিয়ে এনে হাসিমুখে বিলি করছেন। তাঁর ছবি ভাইরাল হয়েছে সোস্যাল মিডিয়ায়। কেউ দূর থেকে তাঁকে ‘দেবুদা’ বলে ডাকছিলেন। কে জানে! হয়তো চেনা! সকাল থেকেই বেশ তীব্র ছিল রোদের তেজ। ভ্যাপসা গরম। মাথার উপরে প্লাস্টিকের চাঁদোয়া খাটিয়ে পিচ রাস্তায় বসে ঘামছিলেন ছাত্র-ছাত্রী ও অন্যরা।
একজনকে হাতে তৈরি হাতপাখা বিলি করতে দেখা গিয়েছে সেখানে। অনেক স্থানীয় মানুষ যে যেরকম পেরেছেন, বাড়ি থেকে রান্না করে এনে দিয়েছেন। তা হয়তো তুলনায় কম সংখ্যক আন্দোলনকারীদের খিদে মিটিয়েছে। কিন্তু, তাঁদের দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকেছেন সকলেই। সৌম্যর কথায়, ‘আমাদের সহ-অভিনেত্রী দেবলিনা দত্তর দাদা-বৌদি দীপাঞ্জন ও তানিয়া মল্লিক সকালে খাবার ও জল এনে দিয়েছেন। তাঁরা বৌবাজারে থাকেন।’
পুলিশের প্রতি একরাশ ক্ষোভ নিয়ে সারা রাত অবস্থানে ছিলেন অভীক পোদ্দার। তবে মঙ্গলবার সকালে তাঁর সেই ক্ষোভ অনেকটাই কমে যখন তিনি দেখেন পুলিশকর্মীরাই জুনিয়র ডাক্তারদের জন্য জলের বোতল এবং ওআরএস-এর প্যাকেট নিয়ে এসেছেন। অভীক বলেন, ‘ওঁরা অনুরোধ করেন আমরা যেন এগুলো নিতে অস্বীকার না করি। আমরা নিয়েছি। পুলিশকর্মীদের ধন্যবাদ।’