এই সময়: রাজ্য সরকারের আনা ‘অপরাজিতা বিল’-এ নীতিগত সমর্থনের কথা মঙ্গলবার বিধানসভায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেছিলেন, এই রাজ্য সরকারের হাতে আরও আড়াই বছরের মেয়াদ রয়েছে, যার মধ্যে এই বিল কার্যকর করে দেখাতে হবে।অথচ এই বিল নিয়ে বিতর্কে বিধানসভার বিরোধী দলনেতার ভাষণ শেষ হলো মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে। শুভেন্দুর নেতৃত্বাধীন বিজেপির পরিষদীয় দলের এই পরস্পরবিরোধী আচরণে ক্ষুব্ধ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার বিধানসভায় দাঁড়িয়েই দাবি করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পদত্যাগ।
বিধানসভায় ধর্ষণ রোধে রাজ্য সরকারের আনা নতুন বিলের নীতিগত বিরোধিতা এ দিন করেনি বিজেপি। তবে এই বিলের উপরে বিতর্ক চলাকালীন আরজি করের ঘটনা নিয়ে শুভেন্দু-সহ বিজেপি শিবির তৃণমূল সরকারের তীব্র সমালোচনা করে। এই বিলের যৌক্তিকতা নিয়েও একাধিক প্রশ্ন তোলে। মুখ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি কলকাতার পুলিশ কমিশনারেরও পদত্যাগের দাবি করেন বিজেপির পরিষদীয় নেতৃত্ব।
বিশেষ করে শুভেন্দুর ভাষণের শেষ লগ্নে যে ভাবে সদলবলে ‘দফা এক, দাবি এক, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ’ স্লোগান ওঠে বিরোধী বেঞ্চ থেকে, তা নিয়েই তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। জবাবি ভাষণে গোটা দেশে নারী নিগ্রহ নিয়ে সটান প্রধানমন্ত্রীকেই কাঠগড়ায় তোলেন মমতা।
বিরোধী বেঞ্চকে নিশানা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আপনি দেশের লজ্জা! আপনি মেয়েদের প্রোটেকশন দিতে পারেন না। তাই আপনার পদত্যাগ দাবি করছি। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছি। বিজেপির মন্ত্রীদের পদত্যাগ দাবি করছি। বিরোধী দলনেতা গুলি চালানোর কথা বলেছেন, তাঁরও পদত্যাগ দাবি করছি।’
‘পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র সমাজ’-এর ব্যানারে গত মঙ্গলবার নবান্ন অভিযানে যাতে গুলি না-চলে, তার জন্য আগাম সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন শুভেন্দু। তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের অভিযোগ, শুভেন্দুর ওই কথাতেই অশান্তি বাধানোর ইঙ্গিত ছিল। তাই মুখ্যমন্ত্রী এ দিন প্রধানমন্ত্রী-কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পাশাপাশি বিরোধী দলনেতারও পদত্যাগ দাবি করেছেন বলে তৃণমূলের পরিষদীয় নেতৃত্ব মনে করছেন।
‘অপরাজিতা বিল’-এর উপরে বিতর্কে এ দিন শুভেন্দু বলেন, ‘এই বিলকে আমরা পূর্ণ সমর্থন করছি। কিন্তু এই বিলকে আইনে পরিণত করে কার্যকর করার দায়িত্ব মুখ্যমন্ত্রীকে নিতে হবে। এই সরকার এখনও আড়াই বছর থাকবে। আমরা রেজ়াল্ট দেখতে চাই।’ এরপরই বিরোধী দলনেতা প্রশ্ন তোলেন, ‘মৃত্যুদণ্ডের সাজা না-থাকলে নির্ভয়া মামলার অপরাধীদের ফাঁসি হলো কী করে? তারও আগে ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের ফাঁসি হয়েছিল কী ভাবে? এখন জনরোষের মুখে সরকার বাঁচাতে নজর ঘোরানোর চেষ্টা হচ্ছে।’
পরে জবাবি ভাষণে মমতা পাল্টা বলেন, ‘এটা মাননীয় রাজ্যপালকে বলুন। এই বিলে (রাষ্ট্রপতির) সই (ব্যবস্থা) করে দিতে। তারপর যদি আইন কার্যকর না-হয়, তার দায়িত্ব আমাদের। উই ওয়ান্ট রেজ়াল্ট অলসো। সেই সঙ্গে আমরা এখন সিবিআইয়ের কাছ থেকে জাস্টিস চাই। বিচার চাই, বিচার চাই, শাস্তি দিক সিবিআই। ফাঁসি দিক সিবিআই। এটা আমরা চাই।’
তৃণমূল নেতৃত্বের পর্যবেক্ষণ, শুভেন্দু অধিকারী যেখানে বিধানসভায় দাঁড়িয়ে বলছেন, বিজেপি বিধায়করা বিলকে সমর্থন করবেন, রাজ্য সরকারের হাতে আরও আড়াই বছর সময় রয়েছে বলেও ভাষণে উল্লেখ করছেন, সেখানে আবার ভাষণের শেষ লগ্নে তিনিই ‘দফা এক, দাবি এক’ বলে স্লোগান দিচ্ছেন আর বিরোধী বেঞ্চ সমস্বরে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি তুলছেন— সেটা একটা পরিকল্পনামাফিক দ্বিচারিতা। সেই কারণে মমতাও তাঁর জবাবি ভাষণের শেষে পাল্টা স্লোগান দিয়েছেন।
তবে বিধানসভায় যে ভাবে শুভেন্দু মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন, তা অত্যন্ত অসম্মানজনক বলে মনে করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। জবাবি ভাষণে মমতা বলেন, ‘যে ভাবে আমাকে অসম্মান করছেন, আপনাদের প্রধানমন্ত্রীকে আমরা সেই ভাবে অসম্মান করিনি। কখনও ভেবেছেন, আপনারা যে ভাবে আমার বিরুদ্ধে বলছেন, আমাদের দল যদি সেই ভাবে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বলে! যদি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বলে! আপনাদের অন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে বলে!’
জবাবি ভাষণে মমতা কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের জমানায় সারা দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনার বিশদ তথ্য-পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, অসম, মধ্যপ্রদেশে সাম্প্রতিক কালে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, শিশুদের যৌন নিগ্রহের একের পর এক ঘটনার উদাহরণও দেন মুখ্যমন্ত্রী।
তাঁর কথায়, ‘উত্তরপ্রদেশে ৭ লক্ষ নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। গুজরাটে হয়েছে ৫ লক্ষ। দেশে প্রতি এক লক্ষ মহিলার মধ্যে ৪.৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। সেখানে পশ্চিমবঙ্গে এই হার ২.৩। এটাও হওয়া উচিত নয়। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশে এই হার কয়েক গুণ বেশি। আগে নরেন্দ্র মোদীকে পদত্যাগ করতে বলুন। মোদীর পদত্যাগ চাই। তার কারণ উনি জাতীয় লজ্জা।’
এই বিলের উপরে বিতর্কে শুভেন্দু অধিকারী, অগ্নিমিত্রা পলরা পশ্চিমবঙ্গে নির্ভয়া তহবিলের অর্থ খরচ, যথেষ্ট সংখ্যায় ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট তৈরি না হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। পাল্টা মুখ্যমন্ত্রী জানান, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের ৮৮টি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের জন্য অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে দিয়েছে। নির্ভয়া ফান্ডে এখনও কেন্দ্রের কাছ থেকে ২৬ কোটি টাকা রাজ্য পায়।
সেই জায়গায় ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর নারী সুরক্ষায় ৪৯টি মহিলা থানা, মহিলাদের জন্য ৫২টি ডেজ়িগনেটেড কোর্ট তৈরি-সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ করা হয়েছে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন। তিনি আরও জানান, আরজি করের তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় পরে ‘রাত্তিরের সাথী’ প্রকল্প রাজ্য সরকার তৈরি করেছে। একশো কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘সিসিটিভি লাগাতে বলা হয়েছে। যেখানে আলো কম, সেখানে আলোর ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। আমরা এই প্রকল্প করেছি মেয়েদের সুরক্ষার জন্য। রাতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের ফুল প্রোটেকশনের দেওয়ার জন্য এটা করা হয়েছে।’